৩ঃ স্লেভারি, রেসিজম এবং কিছু বাংলাদেশীর চোখের জল

সম্প্রতি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার চান্দপুর চা বাগানের অন্তর্গত কিছু ধানী জমিতে ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে কেন্দ্র করে চা বাগানসহ সারা দেশে আন্দোলন কর্মসূচি শুরু হয়। এই বাগান ও জমি ব্রিটিশ ডানকান ব্রাদার্সের মালিকানাধীন।সরকারী প্রজ্ঞাপনে দাবীকৃত অকৃষি/খাস জমি আসলে কৃষি/ আবাদী জমি।
যেহেতু শ্রমিকদের পারিশ্রমিক/ রেশন কোনোটাই পর্যাপ্ত নয়, তাই তাঁদের জীবিকার একটা বড় অংশ এই আবাদী জমি থেকে পাওয়া ফসলের ওপর কিংবা বন্ধকি থেকে প্রাপ্ত অর্থের ওপর নির্ভরশীল। চা বাগান প্রতিষ্ঠার সময় থেকে এই চা শ্রমিকের হাজিরা ছিল ২.৩৫ পয়সা পার ডে যা বর্তমানে অর্থাৎ ২০১৬ সনে হয়েছে ৬৯ টাকা। যদিও এই ৬৯ টাকার পেছনেও শর্ত জুড়ে দেওয়া আছে। শর্ত হচ্ছে, ২৩ কেজি চা জমা দিতে হবে কোম্পানিকে। এর কম হলে ৪ টাকা কেটে নেওয়া হয়। সরকারী উদ্যোক্তারা নিজেরাই বলেন যে এটা অমানবিক। তার পাশাপাশি এই বাগান সংলগ্ন জমিতে চাষবাস করে এই চা শ্রমিকেরা কোনমতে বেঁচে থাকে। তবে এই ভূমিরও মালিকানা তাদের নেই। জমিদারি প্রথা বিলোপের পর রায়তের হাতে ভূমি অধিকার আসার সময় তারা অধিকার পায়নি কারণ তাদের জমিকে চা বাগানের মালিকানার জমি দেখানো হয়। আর সেই আইনি মারপ্যাঁচে ভূমিহীন হয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠী এখন চাইলেও তাদের দরিদ্রতার থেকে উঠে আসতে পারেনা কেননা ভূমিহীন পরিচয়হীন এই জনগোষ্ঠীকে সরকার পর্যন্ত চাকরি দিতে চায়না। তার ওপরে যদি তাদের চাষের আবাদী জমিটা সরকার দখল করে নেয়-তাহলে তাদের বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বনটুকুও থাকেনা।
সরকারের এই অবস্থান সরকারের নিজস্ব বক্তব্যের সাথেই সাঙ্ঘর্ষিক। গত ২২ অক্টোবর বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ(বেজা) এর পরিচালনা পর্ষদের তৃতীয় সভায় প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন: …এই অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলি বেছে নেয়ার সময় আমরা মাথায় রাখছি যে আমার কৃষি নষ্ট হবে না কিন্তু আবার শিল্পায়নটা হবে।
এই জমি বর্তমান শ্রমিকদের পূর্বপুরুষদের জীবন বিপন্ন করে বন-জঙ্গল সাফ করে তৈরী করা জমি। আজ থেকে প্রায় দেড় দুশো বছর পুর্বে ব্রিটিশ শাসকরা চা বাগান করার পরিকল্পনা হাতে নেন। পরিকল্পনা করলেও বনজঙ্গলে ঘেরা পরিবেশ সাফ করে জমিনকে কৃষির এবং চা বাগানের উপযোগী করা সম্ভব হয় এই দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠির মাধ্যমেই। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই চা বাগান এবং চা বাগান সংলগ্ন কৃষি জমিকে ঘিরেই তাদের জীবন। এই ডানকান ব্রাদার্সের হাত ধরেই এই এলাকায় প্রথম চা বাগানের সূচনা হয়। শুধু তাই নয়, তদসংলগ্ন এলাকায় বসবাসরত প্রায় ৯২ টি জাতিগোষ্ঠীর মানুষের (সাঁওতাল, ওঁরাও, ভূমিজ, রবিদাস ইত্যাদি) পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি, শ্মশানসহ বিভিন্ন অমূল্য স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে। ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠা হলে পূর্বপুরুষের বহু কষ্টের জমি, তাঁদের স্মৃতি কিংবা শ্রমিকদের জীবনের অনুষংগ-রূপ সংস্কৃতি- কোনটাই রক্ষা করা যাবে না। যদিও সরকারী তালিকায় স্বীকৃতি না পেয়ে এর মাঝেই এই এলাকার ৮৫টির মতন নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতি অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে।
তথ্যমতে, চুনারুঘাট উপজেলাতেই চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ৪৯ হাজার ৫ শত ৫২ হেক্টর, খাস জমির পরিমাণ প্রায় ১৭ হাজার ৯৬ হেক্টর (প্রায় আড়াই হাজার একর) আর পতিত জমি ৬ হাজার ৬ শত ৯৮ হেক্টর। অর্থাৎ, উক্ত কৃষিঅঞ্চল ছাড়াও অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার যথেষ্ট পরিমাণ জায়গা রয়েছে। কিন্তু স্থানীয়দের ভাষ্যমতে ঐসব জায়গা সেইসব নেতাদের বে-দখলে। তাই, যদি হতদরিদ্র ও প্রান্তিক চা শ্রমিকদের জমিতে ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের জমিতে রমরমা ব্যবসা বসানো যায়, তবে ক্ষতি কি! উন্নয়ন প্রকৃতপক্ষে তাই এই রাজনৈতিক নেতাদের।
এই কৃষিযোগ্য খাসজমি অধিগ্রহণ করা হলেও তা বিনামূল্যে ভূমিহীনদের মাঝে বিতরণ করার কথা, কিন্তু তা কোনভাবেই অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের জন্য না। ভূমিহীনদের মধ্যে যারা- ১। দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, ২। নদীভাঙ্গা পরিবার, ৩। অক্ষম পুত্রসহ বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্তার পরিবার, ৪। কৃষিজমিহীন ও বাস্তুভিটাহীন পরিবার, ৫। ভূমি অধিগ্রহণের ফলে ভূমিহীন হয়ে গেছে এমন পরিবার- এঁদের পরিবারই তা পাওয়ার কথা।
কেবল হবিগঞ্জের চুনারুঘাটেই নয়, অদূরে বৈকন্ঠপূর চা বাগানের চা শ্রমিকেরাও বেঁচে আছেন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মাঝে। প্রায় পনের সপ্তাহের বেশি সময় ধরে তাদের বেতন ভাতা বন্ধ থাকায় অনাহারে অর্ধাহারে এখনও পর্যন্ত মারা গিয়েছে সাতজন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত এদের জন্য আসেনি পর্যাপ্ত সরকারি বা বেসরকারি সাহায্য কারণ এই খবরটা এখনও জনগণের কানেই পৌঁছায়নি। অথচ আমরা চাইলেই কিন্তু এই মানুষগুলোকে মৃত্যুর হাত থেকে বাচাতে পারি, তাদের সংস্কৃতি আর অধিকারের জন্য লড়াইয়ে সাহস জোগাতে পারি। দিনশেষে আমরা যেমন বাংলাদেশী, ওরাও তেমনি বাংলাদেশী, কাজেই ওদের চোখের জল যাতে আমাদের হাতও মুঠো করে-ওদের যেমন আমরা আমাদের রাষ্ট্রের মতন করে পর করে না দেই।
কৃতজ্ঞতাশীর্ষ সংগীতঃ স্বরব্যাঞ্জো – Swarobanjo

গবেষণা সহায়তায়ঃ
Ryan Ahmed Orko
Maha Mirza
Mohan Rabidas

ডেসক্রিপশন:
রায়ান আহমেদ অর্ক,
তন্ময় তালুকদার,
স্বাগ্নিক অনন্য স্বাত্ত্বিক,
আরেফিন নোমান-এর রিপোর্ট থেকে নেয়া

N.B: এই ভিডিওতে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে এর কারন বাংলাদেশের আইনে ঐ শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে । আমরা ঐ আইনি এড্রেস করতেই এই শব্দের ব্যবহার করেছি । আইনটি হচ্ছে –
“ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন – ২০১০’

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.