Why we oppose the Thermal Power Plant on the coast of the Sundarbans–কেনো আমরা রামপাল তাপবিদ্যুতকেন্দ্র প্রকল্পের বিরোধীতা করি

ইন্ট্রো মিউজিকঃ ম্যানগ্রোভের কান্না (স্বরব্যাঞ্জো)
কৃতজ্ঞতাঃ জন অলিভার, স্টিভেন কোলবের আর জন স্টুয়ার্ট

কেনো আমরা রামপাল তাপবিদ্যুতকেন্দ্র প্রকল্পের বিরোধীতা করি

রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড আর ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ব এনটিপিসির যৌথ উদ্যোগে বাগেরহাট জেলার রামপাল থানায় একটি বিদ্যুতকেন্দ্র গড়ে তোলবার জন্য একটি প্রকল্প।এই প্রকল্প নিয়ে এতো আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে কারণ বিদ্যুতকেন্দ্রের অবস্থান সুন্দরবনের আন্তর্জাতিক ঐতিহ্যঘোষিত স্পট থেকে মাত্র চৌদ্দ-থেকে সতের কিলোমিটার। সাড়ে চারবছর ধরে বনের এতো কাছে একটা এতোবড় স্থাপনা বানানো হলে যে পরিমান শব্দ দূষণ, বায়ু দূষণ, বন ধ্বংস, অয়েল স্পিলেজ, বর্জ্য নিষ্কাশন আর নদী ড্রেজিং হবে-তাতে সুন্দরবনের অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে। এই পশুর নদীর ইরাবতী ডলফিন বা আমাদের শুশুক এতে ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের সময় যে সালফার আর নাইট্রোজেন গ্যাস নির্গত হবে তাতে এসিড বৃষ্টি হতে পারে। কঠিন আর তরল বর্জ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বের হয়ে সুন্দরবনের নদীর পানিতে মিশে যেতে পারে। সালফার গ্যাসে ক্যাওড়া গাছ যদি আহত হয় তবে সেই গাছের পাতা খেয়ে বেঁচে থাকা হরিণও আশংকার মাঝে পড়বে। আর এই একই উপায়ে সুন্দরবনের সমগ্র ইকোলজিই কুপ্রভাবের মাঝে পড়তে পারে। (১)
বিদ্যুতকেন্দ্র তৈরীর প্রস্তুতি হিসেবে এর মাঝেই প্রায় ৪০০ একর জমি ভরাট করা হয়েছে যার মাঝে একটা প্রাকৃতিক খাল ছিলো। ভবিষ্যতে আরো বেশি ড্রেজিংএর প্রয়োজন হবে যেটি পশুর আর মৈদারা নদীর জলজ প্রানীদের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। বিদ্যুতকেন্দ্র থেকে মাত্র আট কিলোমিটার দূরে ধাংমারি শুশুক অভায়রণ্যে এর একটা বড় শিকার হতে পারে। (২)
বিদ্যুতকেন্দ্রে কয়লা নিতে গেলে সরাসরি পশুর নদীর উপর দিয়ে বছরে চারশ থেকে পাঁচশটা ট্রিপ নিতে হবে। এই কয়লা কোথা থেকে আনা হবে সেটা এখনো নিশ্চিত করা হয়নি-অস্ট্রেলিয়া, সাউথ আফ্রিকা আর চীনের নাম শোনা যাচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে জোরালো নামটি হলো ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ব কোল ইন্ডিয়ার এবং যেহেতু অর্ধেক মালিকানা ভারতের, কাজেই অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন যে এটা আসলে কোল ইন্ডিয়ার বাংলাদেশের কাছে কয়লা বিক্রি করবার একটি উপায়। এই কোল ইন্ডিয়ার কয়লা ভারত থেকে রামপালে আনতে নদীপথের যেকোন দূর্ঘটনায় বা গাফিলতিতে সুন্দরবনের জলাভূমির ক্ষতি হবার সম্ভাবনা খুবই বেশি। যেরকম একটি ঘটনা ইতিমধ্যে ২০১৪ সালের অয়েল স্পিল দুর্ঘটনায় আমরা দেখেছি। সেইসময়ে আমাদের সরকার কতটা তৎপরতা দেখায় সেটাও আমরা দেখেছি। সেইসময়ে সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া একমাত্র পদক্ষেপ ছিলো-এলাকার মানুষজনকে মাছ ধরার জাল দিয়ে তেল পরিস্কার করে ফেলতে বলা। (২) একই ঘটনা আবার ঘটলে একই ঘটনা আবার ঘটবে-এটা সহজেই অনুমেয়।
এই প্রজেক্টের যে এনভারনমেন্ট ইম্প্যাক্ট এসেসমেন্ট করা হয়েছে তার আগেই এর চুক্তির কাজ শুরু করে দেয়া হয় আর পরবর্তীতে যে ইয়াইএ দেয়া হয় সেটা আসে সরকারের একটি দপ্তর সিইজিয়াইএস থেকে যেখানে কোন এক্সিডেন্ট বা রিস্ক ম্যানেজমেন্টের কোন ব্যখ্যা দেয়া হয়না। সাধারণত এধরণের রিপোর্ট কোন ইমপারশিয়াল তৃতীয় পক্ষ থেকে নেয়া হয়-কিন্তু এক্ষেত্রে সরকারের কাছ থেকেই একটা আধাখেচড়া রিপোর্ট দেয়া হয়েছে যেটাকে সাউথ এশিয়ান রাইটস আর নরওয়ে সরকার পেনশন ফান্ডের এথিকস কাউন্সিল পক্ষপাতী আর অপূর্ণাঙ্গ হবার দায়ে সমালোচনা করেছে।(১)
এই প্রকল্পের তিরিশ ভাগ অর্থায়ন করবে ভারত ও বাংলাদেশের সরকার এবং বাকি অর্থ আসবে ব্যাংক লোন থেকে। তিরিশ ভাগের যতটুকু বাংলাদেশ অর্থায়ন করবে-সেই টাকা আসবে জনগনের ট্যাক্সের টাকা থেকে। অথচ জনগণের টাকা দিয়ে সরকার এমন একটা প্রকল্প গড়ে তুলতে চাইছে যে সেটাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সেই জনগণই।
সরকার বলছে যে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আরো বেশি বিদ্যুৎ আসবে-জনগণের সুবিধা হবে। অথচ আন্তর্জাতিক এনার্জি ইকোনমিকস আর ফাইনান্সিয়াল এনালাইসিস প্রতিষ্ঠান আইইইএফএ বলছে যে এই প্রজেক্টের কারণে বিদ্যুতের দাম না কমে বরং বাড়বে।(১) সেই বিদ্যুতের দাম বেড়ে যে পর্যায়ে পৌছাবে সেটা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে বাস্তবস্মত নাও হতে পারে।
এই যে বিদ্যুতকেন্দ্র হচ্ছে তার শতকরা পঞ্চাশ ভাগের মালিক হবে ভারতের সরকার আর পঞ্চাশ হবে বাংলাদেশ। অথচ এই বিদ্যুতকেন্দ্রের জমি, কর্মী আর পরিবেশগত ঝুকি পুরোপুরি বাংলাদেশের। মোট খরচের তিরিশ শতাংশ দেবে ভারত বাংলাদেশের সরকার আর বাকি সত্তর শতাংশ আসবে ব্যাংক লোন থেকে-যেটার একটা বড় অংশ দেবে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ব এক্সিম ব্যাংক যার অর্থায়নের পিছনে রয়েছে ভারত হেভি ইলেকট্রিক কম্পানি।(১) ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বিদ্যুতখাতে ক্ষতির পরিমান প্রায় এক বিলিয়ন ডলার। সেখানে একটা অতি ভর্তুকিপ্রাপ্ত, অতিরিক্ত ট্যারিফওয়ালা দামি বিদ্যুৎ বেচে সরকার ঠিক কতটুকু টাকা তুলে এনে সেটা দিয়ে কতটুকু লোন ফেরত দিতে পারবে সেটা সহজেই বোঝা যায়।কাজেই লোনের টাকা ইন্টারেস্টসহ ফেরত দিতে হবে গাঁটের পয়সা থেকে অর্থাৎ কৃষক আর দিনমজুরের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে। অথচ সেই টাকা দিয়ে বানানো বিদ্যুৎ হয়তো তারাই কিনে ব্যবহার করবার সুযোগ পাবেনা-কিন্তু বানানোর সময় তাদেরকে ঘর থেকে খেদিয়ে দিতে আমাদের সরকারের দুইবার ভাবতে হয়নি।
এইরকম সরকারী কোন কাজে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে ১৯৮২ সালের রিকুইজিশন অফ ইম্মুভেবল প্রপার্টি অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী সরকারের একটি তিন ধারার নোটিশ দেবার কথা। এরপর তাতে কারো অবজেকশন থাকলে ছয় ধারার নোটিশ দিয়ে জানানো যাবার কথা। যদি সেই অভিযোগ মেটানো যায়-তবে প্রশাসন আবার সাত ধারা একটা নোটিশ দিয়ে ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি মিটিয়ে জমিটি গ্রহণ করতে পারে।(২)
অথচ এইক্ষেত্রে সাইট ক্লিয়ারেন্স বা এনভারনমেন্টাল ক্লিয়ারেন্সের আগেই জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়ে যায়। তিনধারা নোটিশ দেয়া হয়েছে-কিন্তু জমির মালিকেরা যখন বিরোধিতা করেছে তখন সরকার গুন্ডা পান্ডা ভাড়া করে তাদেরকে এলাকা থেকে বলপূর্বক তাড়িয়ে দিয়েছে।(২) ছয় ধারা সাত ধারা এই দুঃখী পরিবারগুলোর অশ্রুধারা হয়ে ঝরে পড়েছে।
সরকারের পক্ষ বলা হয়েছিলো যে এই প্রজেক্টের জন্য দেড়শ পরিবারকে পুনসংস্থান করতে হবে কিন্তু আদতে এর মাঝেই চারশ পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। অধিকাংশ পরিবার কোন ক্ষতিপূরণ পায়নি আর যারা পেয়েছে তারাও মার্কেট প্রাইসের চেয়ে অনেক কম পেয়েছে। তাদের প্রতি একরে দুই লাখ টাকা দেয়া হয়েছে যেখানে মার্কেটে এলাকার জমির দাম ছয়লাখ টাকা-সরকারি কমপেনসেশনের তিন গুন।(১)
যেসব পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে-সরকারী হিসাবমতেই তাদের প্রতি পরিবারে গড়ে তিনটা থেকে দুইটা গরু, চারটা করে ছাগল, একটা ভেড়া, পাচটা হাস আর সাতটা করে মুরগী রয়েছে। যে ১৮৩৪ একর জমি দখল করা হচ্ছে তার মাঝে অধিকাংশের মালিক চিংড়ি ঘের করে, আর ধান গলায়। এই জমি থেকে ৬২,৩৫৩ টন চাল আর ১৪০,৪৬১ টন অন্যান্য শস্য উৎপাদিত হয়। সরকারের হিসাবই বলছে যে এই প্রকল্প এই এলাকায় মুক্ত জলজ প্রাণীর আবাসনে সমস্যা সৃষ্টি করবে, নদী-খালবিলের পানি আর মাছ ড্রেজিং, ট্রাফিক চলাচল আর তেল ও রাসায়নিক স্পিলেজে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। কিন্তু যে লাভের লাভ হবে তাতে এই সব সমস্যা হারিয়ে উন্নয়নে সয়লাব হয়ে যাবে-যদিও ঠিক বিটিভির মতন করে, এই সরকারী রিপোর্টও সেইটার কোন ব্যখ্যা দেয়া হয়নাই।

তথ্যসূত্র
১) ইন্সটিটিউট অফ এনার্জি ইকোনমিকস এন্ড ফাইনান্সিয়াল এনালিসিস (২০১৬), রিস্কি এন্ড ওভার সাবসিডাইজডঃ আ ফিনান্সিয়াল এনালিসিস অফ দ্য রামপাল পাওয়ার প্ল্যান্ট। অথরঃ শারদা ও বাকলি।
২) সাউথ এশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস (২০১৬), রিপোর্ট অফ ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন টু রামপাল, বাংলাদেশ। কলম্বো, শ্রীলংকা
৩) গার্ডিনার হ্যারিস (২০১৪), বরোড টাইমস অন ডিস্যাপিয়ারিং ল্যান্ড, নিউ ইয়র্ক টাইমস, নিউ ইয়র্ক, নিউ ইয়র্ক।
৪) মিজানুর রহমান (২০১৪), রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র (টেলিভিশন ব্রডকাস্ট), ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশন, ঢাকা, বাংলাদেশ।
৫) দীপক ঘোষ (২০১২), নয়ারচর পাওয়ার প্রজেক্ট হিটস রোডব্লক (টেলিভিশন ব্রডকাস্ট), এবিপি আনন্দ, কলকাতা, ভারত।

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.