অসাম্প্রদায়িকতার সমস্যা

আপনাদের অনেকের খারাপ লাগলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর ধর্ষণ নিয়ে অনেক প্রতিবাদ হইলো কিন্তু তার পরে যে এতোগুলা রেইপ হইলো, এমনকি কাফরুলে যে অভিযোগ অনুযায়ী স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মীরা স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ করলো, সেটা নিয়ে আওয়াজ উঠলো না কেন? কিন্তু আওয়াজ না ওঠাটাই কিন্তু স্বাভাবিক।
মানে “প্রগতিশীল” স্বপ্ন স্বার্থক হইসে। আমরা অসাম্প্রদায়িক হয়ে গেছি। সম্প্রদায়ের বোধ থাকলে আমরা আমাদের শ্রেণী-পরিচয়ের বাইরে বের হইতে পারতাম। যেহেতু আমরা অসাম্প্রদায়িক, আমাদের কাছে ব্যক্তিই সর্বোচ্চ মাননীয়।
কিন্তু ছাত্রদের আবার এমন হইলে হবেনা! শুধু ক্যাম্পাসের অনাচার দেখলে হবেনা! ছাত্রদেরকে জাতীয় স্বার্থ দেখা লাগবে। কেনো? কারণ আমাদের সমাজের আওয়াজ তোলার এখতিয়ার ও দায়িত্ব আমরা ছাত্রদের একক হাতে তুলে দিয়েছি। আমরা আমাদের ইতিহাসে ছাত্রদের অগ্রগামী ভূমিকাকে রোমান্টিক বানাতে বানাতে সেটা একক বানিয়ে ফেলেছি। যেনো সমাজে যা কিছু হবে সেটা নিয়ে ছাত্রদেরই কথা বলতে হবে, আর কারো যেনো কোন দায় নাই।
তবে আমাদের গণআন্দোলনের ইতিহাসে ছাত্রদের ভূমিকা অগ্রাগামী হতে পারে, তবে একক নয়। অনেক আন্দোলন প্রতিবাদ করেছে নাগরিক সমাজ, সুশীল সমাজ, পেশাজীবি, শ্রমজীবি, কৃষক, শ্রমিক এবং রাজনৈতিক দল। তবে এখন যেনো তারা চুপ করে অধিকার আদায়ের একক দায়িত্ব ছাত্রদের দিয়ে বসে গেলো। মাত্র কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশই চুপ করে পেছন থেকে ছাত্রদের উসকানি দিয়ে যাচ্ছে। কেন?
কারণ এই সংগঠনগুলা এখন আর সংগঠন বলে কিছু নাই। এগুলা হইসে ব্যক্তিমানুষের সমষ্টি যাদের কাছে ব্যক্তির স্বার্থ দলের স্বার্থের চেয়ে ঊর্ধ্বে আর দলের স্বার্থ দেশের স্বার্থের চেয়ে ঊর্ধ্বে। এই দল কোন শ্রেণী, কোন পেশা, কোন পরিচয়–যেকোন কিছু হইতে পারে।
তবে পরিচয়ভিত্তিক এমন দল সবসময়ই থাকে, কিন্তু দলগুলার মাঝে ইন্টারসেকশনালিটী থাকে, অর্থাৎ এক দলের মাঝে আরেক দলের লোক থাকে। এখন সেটা কমে আসছে। নির্দিষ্ট শ্রেণীতে, নির্দিষ্ট পেশাকে, নির্দিষ্ট সংগঠনে নির্দিষ্ট ধরণের বাইরে, নির্দিষ্ট স্বার্থের বাইরে লোক পাওয়া যায় না। স্বার্থ ছাড়া মানুষ হয় না, কিন্তু স্বার্থের বৈচিত্র ব্যতীত সংগঠন হয় না। যেটা হয় সেটা হলো হয় একটা ফ্যান ক্লাব, নাহয় একটা কাল্ট।
কাজেই এরকম পরিচয় আবদ্ধ দলগুলো কেবল নিজেদের স্বার্থ নিয়েই থাকে। কিন্তু এই স্বার্থগুলা সামষ্টিকভাবে কল্যাণমুখি না, ইউটিলিটারিয়ান। অর্থাৎ, অনেকজন পোশাক শ্রমিকের মাঝে একজন ধর্ষণ হলে বাকিরা চুপ থাকবে কারণ কিছু করলে অধিকতর সংখ্যক মানুষ ঝুঁকির মুখে পড়ে। কাজেই তারা ঝুঁকি কেন নিবেন?
নিবেন না, কারণ তারা ব্যক্তি। ওইযে, কি কি বাদীরা জানি বলেন না…সবার উপরে তিনি মানুষ? ওই একক মানুষ পরিচয় নিয়ে বিশ্বের সকল মানবতার জন্য অন্তর কান্দানো যায়, কবিতা লেখা যায়–এবং অবশ্যই সেটাও নেসেসারি। কিন্তু ওই পরিচয় দিয়ে লড়াই করা যায়। যে দেশে বিগ্রহ কম, যেখানে টিকে থাকাটাই একটা নিত্যকার অস্তিত্বের যুদ্ধ না, সেখানে হয়তো ব্যক্তিপরিচয় খাটে, কিন্তু এই লড়াইয়ের বদ্বীপে ওই আধাখেঁচড়া ব্যক্তিপূজারী পুঁজিবাদ আমি চাইনা। এখানে শিল্পের বিকাশ নাই, কিন্তু ব্যক্তিসত্ত্বার বিকাশ করে গোষ্ঠী-সম্প্রদায় ধ্বংস করে দেয়া হইসে। কাজেই মানুষের নিজের পরিচয়ের বাইরে কি লড়াই করার কোন কারণ নাই।
কাজেই ছাত্ররা যে নিজের ক্যাম্পাসের বাইরে গিয়ে লড়বে, সেই আশা কেনো করবেন? ছাত্ররা কি পেশাদার এক্টিভিস্ট নাকি রাজনীতিবিদ? আমরা রাজনীতিবিদ- এক্টিভিস্টরাই অধিকাংশ সময় খালি প্রেস ক্লাবে-শাহবাগে ঘুরে, মাতারবাড়ি-মহেশখালি যাইতে পারিনা–আমরা ছাত্রদের কোন মুখে দায় দেই ক্যাম্পাস থেকে বাইর হইতে? ওদের কি এইটা কাজ? দুনিয়ার সব দায় ওদের ঘাড়ে কেন পড়বে? আমরা আমাদের দেশ ছাড়েন মিয়া, গোষ্ঠীর জন্য কি করসি? ও তো তাও ওর ক্যাম্পাসে দাড়াইসে, আমি আমার সমাজের জন্য কি করসি? কাফরুলের ধর্ষণের শিকার শ্রমিকের জন্য আমিই দাড়ানোর জন্য দশ বিশজন লোক পাইনা, কিন্তু ক্যাম্পাসের ছেলেপেলের যাইতে হবে সারা দুনিয়ায়? কেন? আপনি আসতে পারেন না আপনার চাকরি আছে-ফ্যামিলি আছে, ওদের পড়াশুনা নাই? জীবন নাই? আমাদের সব দায় ওদের কেনো নিতে হবে? ট্যাক্সের টাকা ওদের পড়ার জন্য দিসি, আমার হয়ে ক্রান্তিকামলা খাটার জন্য দেইনাই।
নিজের লড়াই নিজেকেই করতে হয়। ওরা হয়তো এখন সবকিছুকে নিজের ভাবতেসে না। আপনি কি ভাবতেসেন? ভাবলে নামেন। আসেন। লড়েন। কেউ থামাইসে? ডাকতেসি বরং কতোদিন ধরে। আসেন না কেন?
বেহুদা অন্যরে দোষ দিয়েন না। নিজেরা কিছু কেন করতে পারতেসিনা সেটা ভাবেন।

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.