রূপান্তর

রূপান্তর

ভোরবেলা দুঃস্বপ্নের ঘুম ভেঙ্গে উঠে অরুণিমা আবিস্কার করল সে মিসেস চক্রবর্তীতে রূপান্তরিত হয়েছে। তার সমগ্র শরীর গোখরো সাপের মতন করে পেচিয়ে রেখেছে লাল বেনারসি, লোহার হাতকড়ার মতন শাঁখা তার কব্জি চেপে ধরেছে আর গলায় ফাঁসির দড়ির মতন ঝুলছে একটা মঙ্গলসূত্র। মাথার নিচের শিমুল তুলোর বালিশ রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে। রক্ত তার কপাল থেকে ফিনকি দিয়ে বেরিয়েছে। সেই রক্তে তার সারামুখও মাখামাখি হয়ে রয়েছে। শাড়ির বাধনে নড়তে অক্ষম অরুণিমা অসহায়ের মতন তার সারা শরীরের কিলবিলে গয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে।

‘আমার কি হয়েছে?’  বেকায়দায় শুয়ে শুয়েই ভাবলো অরু। এটা তো স্বপ্ন হতে পারেনা। অরু তার চিরপরিচিত চারদেয়ালের ঘরের মাঝেই শুয়ে রয়েছে। একদেয়ালে তাকভরা বই, টেবিলের ওপর ছড়ানো মেডিকেল জার্নাল আর ঠিক ওপরে ফেমিনিজমের একটা  হলদে পোস্টার। পোস্টারটা অরুণিমা নিজে প্রিন্ট করিয়েছে,এমন পোস্টার বাজারে মেলা ভার। পোস্টারে একটা মহিলা হাতের পেশি ফুলিয়ে ঔদ্ধত্যময় দৃষ্টিতে পৃথিবীকে বলছে-আমরাও পারি। চিরপরিচিত দৃশ্যপট।

অরুর জানলা দিয়ে এক চিলতে আকাশ দেখা যায়। আকাশজুড়ে মেঘ করেছে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। এমন সময়ের জন্মই হয়েছে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমানোর জন্যে। ইশ!আরেকটু ঘুমিয়ে নিলেই আরেকটু মুক্তি পাওয়া যায়!

উপুড় হতে চারহাত পা ছড়িয়ে ঘুমোনোর অভ্যাস অরুণিমার। মা বলেছে ওভাবে শুতে নেই। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা মন্দ বলবে।

স্বশুরবাড়ি,বাপেরবাড়ির লোকজনের মন যোগাতে যোগাতে নিজের বাড়ি হারিয়ে ফেলেছে অরুণিমা। সারাদিন লাগাতার এইবাড়ি ওইবাড়ি দৌড়ানোর ঝক্কি। আজ মেসোশ্বসুর-কাল ভাশুরের শালা তো পরশু মেজোবৌদির ননদের বাড়ি। আবার একেকবাড়ির একেক রকম রীতিনীতি-সংস্কার। যে বাড়িই হোক না কেন-সবার মাঝে একটা ব্যাপার কমন-খুঁত বের করা বাদে তাদের আর খেয়েদেয়ে কোন কাজ নেই।

ধুশশালা, মরুকগে সব! আপাতত পাছা চুলকাচ্ছে অরুণিমার। কোনমতে কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে শরীরটা একটু বাঁকালো, অতঃপর অতি সন্তপর্ণে তিন চারপ্রস্থ কাপড়ের ভেতর হাত গলিয়ে চুলকানো। আহ!কি শান্তি!

প্রতিদিন কাক ডাকার আগে ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরে ঢুকতে হলে বুদ্ধি কাকদের থেকেও কম হয়ে যায়। আরেবাবা!ঘুমেরও তো দরকার আছে,নাকি? রাতের বেলা স্বামীর জ্বালায় জেগে থাকো,ভোরের আগে স্বশুরের জন্য রান্না করো। শাশুড়ি তো বেলা পর্যন্ত পড়ে পড়ে ঘুমায়। এরপর খাবার টেবিলে তিন রাজা-রানী বসে ঝিমাবে আর আমি একটু ঢুলে পড়লেই দোষ, ‘বাবা-মা কিছু শেখায়নি!’

এই বাবা-মার মুখের দিকে তাকিয়েই এতোদিন পর্যন্ত মুখ বুজে আছে অরুণিমা। নাহলে কবেই শাশুড়ির মুখে ঝামটা মেরে বলতো, ‘এইযে! গন্ডমূর্খ ঘষেটি বেগম!জ্বী,আপনাকে বলছি-শুনুন। আমি অরুণিমা চৌধুরি,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-এপ্লায়িড ফিজিক্স ফাইনাল ইয়ার-ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। আমি প্রতিদিন আলো ফোটার আগে ঘুম থেকে উঠে রুটি আর আলুভাজি বানাতে পারবো না।’

ইশ! একধাক্কায় হিটলার শাশুড়ি হয়তো হার্টফেল করে মরেই পড়তো। তাতেই হয়তো অরুর মুক্তি।

চিরপরিচিত জীবনাচরণে ফিরে যাবার জন্য অন্তরটা হাঁসফাঁস করছিলো অরুণিমার!তার জন্যে প্রয়োজনে এক আধটা মানুষ মারা পড়লেও খুব একটা সমস্যা নেই তার।

একবার পতিপমেশ্বর বিলেত ফিরে গেলেই অরুণিমা বাপের বাড়ি ফিরে গিয়ে আবার পড়াশুনা শুরু করবে-এই ছিলো তার পরিকল্পনা।

‘ছিলো!’

পতিদেব বিলেত ফিরে গেছেন,অরুও বাপের বাড়ি ফিরেছে। কিন্তু পড়াশুনা আর করা হচ্ছেনা। বাবা-মাও কেমন সারাদিন বিয়ের পর কিভাবে চলনবলন করতে হয়, তা-ই শিখাতে ব্যস্ত। স্বশুর শাশুড়ির মন যোগানো যাবতীয় কৌশল তাকে হাতে কলমে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে।

শ্বশুর শাশুড়ির ইচ্ছে-যাতে অরুণিমা নিজের নাম এফিডেবিট করে  অরুণিমা রায়ের থেকে মিসেস অরুণিমা চক্রবর্তী করে ফেলে। বাবারও তাই মত। বিবাহ সম্প্রদান কারক!

আজই সেই নাম এফিডেবিট করতে যাবার কথা। সকাল সাতটা বাজে গাড়ি নিয়ে উপস্থিত হবেন স্বশুর মহাশয়। বাপেরবাড়ি থেকে স্বশুরবাড়ি। শ্বশুরবাড়ি থেকে উকিলের চেম্বার।

উঠতে হবে।কমপক্ষে পাঁচটার সময় ঘুম থেকে উঠে স্নান করে,খাওয়াদাওয়া করে, শাড়ি পরে সুশীলা বাঙ্গালী বউ হয়ে উঠতে হবে। ডানপিটে ভার্সিটি ছাত্রীকে লুকাতে হবে চারপ্রস্থ কাপড়ের তলে। তবেই স্বশুরের মন শান্ত হবে-অতীত পেছনে পড়েছে! শ্বশুর শান্ত তো বাবা,মাও শান্ত। বাবা মা শান্ত হলেই অরুণিমা শান্ত।

ক্যাঁচ ক্যাঁচ একটানা একঘেয়ে চিৎকার করে যাচ্ছে বজ্জাত এলার্ম ঘড়িটা!

হয়েছেটা কি?

হা ভগবান! সাড়ে সাতটা বাজে। অরুণিমার চোখ অক্ষিকোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম ! সাড়ে সাতটারও বেশি-প্রায় পৌনে আটটা। কি হলোটা কি? এলার্ম কি বাজেনি? অবশ্য গাঢ় ঘুমের মাঝে এলার্মের শব্দ শুনতে না পাবার সম্ভাবনা আছে। ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে হয়তো সেই ভোর থেকেই বেজে চলেছে।

যদিও ঘুমটা বেশ একটা আরামের হয়নি অরুর-একের পর এক দুঃস্বপ্ন। কে জানে!হয়তো সেইজন্যেই বেশি গভীর হয়েছে। তাছাড়া কতদিন একটু আরাম করে ঘুমায়না অরু। একবার সুযোগ পেয়ে দেহমন একেবারে কান্ডজ্ঞান হারিয়ে বসেছে। এখন স্বশুরমশাই এসে উপস্থিত হলেই হয়েছে। একটুও রেডি হয়নি অরুণিমা। মুখও ধোয়নি। সারা শরীর আলুথালু, সিঁদুর লেপ্টে আছে সারামুখে। শ্বশুর নিশ্চয়ই দেখেই মাকে বলবে, ‘আপনাদের মেয়ে কি এরকম দিনের বেলা পড়ে পড়ে ঘুমোয়? সারারাত জেগে করে টা কি?’

এ খবর চাউর হতেও সময় লাগবে না। শ্বশুরকে বসিয়ে রেখে বউ ভোস ভোস করে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে! পায়ে পায়ে টিপ্পনি কাটবে শাশুড়ি!

না!এ হতে দেয়া যায়না।

অরুণিমা আলোর বেগে মাথার মধ্যে সব গুছিয়ে নিতে থাকে। কি করে পাঁচ মিনিটের মধ্যে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে সুশীলা বাঙ্গালী বধূ হিসেবে  শ্বশুরমশায়ের সামনে উপস্থাপন করা যায়…

এমন সময়ে খুব সন্তপর্ণে কেউ দরজায় টোকা দিলো, ‘মাগো!সাড়ে সাতটা বেজে পার হয়ে গেলো।তোমার শ্বশুরমশায় রওনা দিয়ে দিয়েছেন। ঘুম থেকে উঠবি না মা?’

তড়িঘড়ি করে উত্তর দিতে গিয়ে সব গুলিয়ে ফেললো অরুণিমা। মুখ থেকে শব্দ বের হতে চায় না। মাথার মাঝে চিন্তাও গুলিয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে সবকিছু কেমন যেন আবছা আবছা লাগছে। চোখ জলে ভরে গেলে যেমন হয়, তেমনি। তবু কোনমতে অরুণিমা বললো ‘উঠছি,মা!’ নিজের গলা শুনে নিজেই চমকে উঠলো অরু! অরুর গলার আওয়াজ ক্যাম্পাসের মাঝে বিখ্যাত। পার্টির সব মিছিলে স্লোগান দেবার জন্যে অরুই দাড়াতো সবার সামনে। সেই অরুর গলা থেকে এমন ইঁদুরের মতন মিনমিনে আওয়াজ বেরুচ্ছে কেনো?

দরজার ওপাশ থেকে অবশ্য স্বরের তারতম্য বোঝা গেলো না। মা চলে গেলেন। অবশ্য এই ছোট্ট বাক্যালাপ ঘরের সবাইকে জানিয়ে দিলো যে অরু এখনো বিছানা ছাড়েনি। বাবা এলেন প্রায় সাথেসাথেই। সেই ছোট্টবেলায় অরুকে স্কুলে পাঠানোর সময় যেভাবে ডাকতেন,সেভাবে ডাকতে শুরু করলেন। ‘অরু,এই অরু-অরু রে!মা ওঠ ওঠ ওঠ! বেলা হয়ে গেলো যে।তোর শ্বশুরুমশায় চলে আসছেন তো!ওঠো মা,ওঠো।’

গলার সমস্ত শক্তি একত্র করে অরু জবব দিলো, ‘উঠি।’

জীবনে কখনও অরু এক শব্দে কোন কথার জবাব দেয়নি। ছোটবেলা থেকেই সে মহাপ্রসিদ্ধ বাচাল ডাকনামে।তবে বাবা এই তারতম্য লক্ষ্য করলেন না। তিনি অরুর শ্বশুরমশায়ের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত। কিন্তু অরুর ছোটবোন নিরুপমা টের পেলো যে দিদির কিছু একটা হয়েছে। জন্মের পর থেকে দিদিই তার সবচেয়ে কাছের মানুষ। সে যদি টের না পায় তাহলে কে আর টের পাবে! সে ফিসফিস করে পেছনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, ‘দিদি,আমি নিরু। তোর কি হয়েছে?দরজাটা খোল প্লিজ।’

অরুর অবশ্য দরজা খোলার সামান্যতম ইচ্ছা নেই। বরং তার শান্তি লাগছে! ভাগ্যিস দুটো দরজাতেই ছিটকিনি লাগিয়েছিলো। পতিপরমেশ্বরের সাথে রাত কাটানোর একটা সুবিধা অন্তত পাওয়া গেলো!

এখন সর্বপ্রথম করণীয় হলো, শান্তিমতো উঠে দাঁড়ানো, মুখ ধোয়া, শাড়ি বদলানো আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল-নাস্তা করা। তবে গোখরো সাপের প্যাঁচের থেকে নিজেকে ছুটিয়ে উঠে দাঁড়ানো কিকরে সম্ভব হবে,সেটা এখনও অরু হিসেব করে বের করতে পারেনি। বিশেষত হাতের মাঝে এই জবরজং হাতকড়া পরা অবস্থায়।

দুবার ঘন ঘন নিশ্বাস ফেললো অরু। এরপর হিসেব করতে লাগালো তার পরবর্তী করণীয়। প্রথমেই হাতজোড়া মুক্ত করতে হবে। কিন্তু তার দুইহাত পিছমোড়া করে বাধা। একহাত দিয়ে আরেকহাত খোলা যাচ্ছেনা।

কিছুক্ষণ নিশ্চল হয়ে পড়ে থাকলো অরু। বন্দিনীর মতন আবছা গুঙিয়ে হাতের বাঁধন ঢিলা করবার চেষ্টা করলো। কিন্তু হাতীর দাঁত দিয়ে বানানো হাতকড়ার বাঁধন ঢিলা করা যাচ্ছে না। বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পর অরুর মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। একটু বিপজ্জনক,কিন্তু অরুর হাতে বিকল্প ভাবার সময় নেই। কোনমতে খাটের মাথার শক্ত কাষ্ঠল জায়গাটার কাছে সে হাতজোড়া নিয়ে গেলো। এরপর জোরে জোরে শাখাজোড়াকে খাটের সাথে ঠুকতে লাগলো। পরিবারের সবাই শ্বশুরের মনোরঞ্জের জন্য ঘর গোছাতে ব্যস্ত।নইলে এই শব্দ শুনে নির্ঘাত তাদের মনে হতো অরু একলা দেয়ালে মাথা ঠুকছে।

শাখাজোড়া ভেঙ্গে গেলো।অরুর হাত মুক্ত। অনেকক্ষণ পরে অরুর নিজেকে একটু মানুষ মানুষ লাগতে লাগলো। তবে মুক্তির আস্বাদে সে এতই আত্মহারা হয়ে পড়েছিলো যে সে খেয়ালই করেনি যে কবজি বরাবর একটি গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। সেখান থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে।

হাত মুক্ত হবার সাথেসাথেই গলার ফাঁস খুলে ছুঁড়ে ফেললো অরু।কিন্তু পা-জোড়া তখনও বাঁধা। অনেকক্ষণ ধস্তাধস্তি করেও অরু খুব একটা জুত করতে পারলো না।

ধস্তাধস্তিতে উলটো বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়লো অরু।

ক্লান্তির ঠেলায় একটু বিশ্রাম নিতে গিয়েই অরুর মাথায় ফের একটা বিপজ্জনক বুদ্ধি খেলে গেলো। একটি একটি করে হাত পা মুক্ত না করে সে একবারে পুরো শরীর দোলাতে শুরু করলে একবারে পুরো দেহ নিয়ে খাট থেকে নিচে পড়তে পারে সে।কিন্তু সমস্যা হলো,সবার আগে যদি মাথাটা পড়ে মাটিতে ঠুকে যায় তাহলে মারাত্মক ব্যাথা পাবে,জ্ঞানও চলে যেতে পারে। এই মূহুর্তে আর যা-ই হোক,অজ্ঞান হওয়া চলবে না।

বেল বাজলো। ঘরের ভেতর একটা শোরগোল পড়ে গেলো। শ্বশুরমশায় এসেছেন। মা দৌড়ে দরজা খুললেন,বাবা বললেন, আসুন বেয়াই আসুন। অনেকদিন পরে এলেন।আছেন কেমন?শরীরস্বাস্থ্য ভালো?

শ্বশুর পরমেশ্বর বড় কৃপা করে বললেন, হুম।

প্রায় কাঁধে করে তাকে নিয়ে বসার ঘরে বসালেন বাবা। মা টেবিলে সাজালেন অষ্টব্যঞ্জন।

শ্বশুর বললেন, ‘এতসব খাবোনা।বৌমা কোথায়?তাকে ডাকুন।’

‘অরু!বেয়াইসাহেব এসেছেন।এদিকে আয় মা!’

‘সন্তানকে তুই করে ডাকবেন না।এতে তারা বেয়াদবি শেখে।’

বাবা বিগলিত কন্ঠে বললেন, ‘তা তো বটেই! আমার স্ত্রী বোকা মহিলা,এই এইসব অশিক্ষিতদের মতন ভুল করে। আমি ডাকছি।মা অরু-এসো মা,তোমার শ্বশুরমশায় অপেক্ষা করছেন’

অরুর আর কোন উপায় নেই। যা হবার হোক,তাকে এখন বিছানা থেকে নামতেই হবে। শরীরটা দুলিয়ে দুলিয়ে সে অভিকর্ষের মায়ায় বিছানা থেকে গড়িয়ে দিলো। ধুপ করে একটা শব্দ এলো অরুর ঘর থেকে।

‘কিছু একটা পড়ে যাবার শব্দ হলো বোধহয়!ওটা অরুর ঘর না?’ বিজ্ঞ শ্বশুর বললেন।

‘মা,অরু।তুই ঠিক আছিস?’

প্রবল ব্যাথায় অরুর সারা শরীর অবশ হয়ে যায়। কোমরের কোন একটা হাড্ডি ভেঙ্গে গেলো নাকি?

‘অরু,তোমার শ্বশুরমশাই অপেক্ষা করছেন।দরজা খোল’

অরু কি জবাব দেবে ভেবে পাচ্ছে না। তার শ্বশুরমশাই কিভাবে বুঝবেন অরুর কি হয়েছে। অরুর যা হয়েছে তা কি শ্বশুরমশায়ের সাথে কখনও হওয়া সম্ভব? যুক্তি অবশ্য বলে যে তাও সম্ভব। হয়তো তিনি একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখলেন তিনি ‘চক্কোত্তি মশাই’ থেকে হঠাৎ করে বুড়ো দাদুভাই হয়ে গেছেন!তার অবস্থান বৃদ্ধাশ্রমে।

কোলাপুরি চপ্পলের আওয়াজ শোনা গেলো। শ্বশুরমশাই ঘরে ঢুকেও চপ্পল খোলেননি। চপ্পলের শব্দ আগাতে আগাতে অরুর ঘরের সামনে এসে থামলো।

ওপাশের দরজা থেকে নিরু ফিসফিস করে বললো, ‘দিদি,তালৈমশায় এসেছেন।’

‘আমি জানি’ আর কেউ শুনে ফেলার ভয়ে চাপা স্বরে নিজেকেই বলে অরু।

‘অরু!’ বাবা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে।

‘তোমার শ্বশুরমশায় জিজ্ঞেস করছেন তুমি কেন সকালে ঘুম থেকে উঠে রেডি হওনি ।আমি জানিনা ওনাকে কি জবাব দেবো। তুমি বরং নিজেই একবার ওনার সাথে কথা বলে ওনাকে বুঝিয়ে বলো।তাড়াতাড়ি দরজাটা খোল মা। ঘরদোর একটু নোংরা থাকলেও সমস্যা নেই’-দরজা খোলার আগে ঘরটা একটু গুছিয়ে নেয়ার ইঙ্গিত দিয়ে দিলো বাবা।

ওর শরীরটা ভালো নেই’ মা শ্বশুরমশাইকে বুঝ দেবার চেষ্টা করছে। ‘বিশ্বাস করুন,ওর শরীরটা বড্ড খারাপ। নইলে আমার অরু প্রতিদিন সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে ঘরের সব্বাইকে ডেকে তোলে। তারপর আমাদের নাস্তা বানিয়ে খাওয়ায়।ওর রান্নার হাত কিন্তু চমৎকার,আপনারা অবশ্য খেয়েই দেখেছেন।ও কিন্তু সব নিজেই শিখেছে,আমি কিছুই শেখাইনি’ একটার পর একটা মিথ্যে বলে মিথ্যের পাহাড় বানাচ্ছে মা। ‘ও প্রতি সন্ধ্যায় নিজের থেকে ঠাকুরঘরে গিয়ে প্রদীপ জ্বালায়।আজকালকার সব ছেলেমেয়েদের ঠাকুরদেবতার থেকে ভক্তিশ্রদ্ধা উঠেগেছে।চারদিকে নাস্তিক। অথচ আমার অরুর ধর্মকর্ম দেখলে আপনি মুগ্ধ হয়ে যাবেন! প্রত্যেকদিন ব্রহ্মলগ্নে ঘুম থেকে উঠে সূর্যপ্রণাম করে।আজ নিশ্চয়ই প্রচন্ড শরীর খারাপ।নয়তো ও সূর্যপ্রণাম করতে ভুল করে না। শাস্ত্রে অসুস্থ শরীরে সূর্যপ্রণাম না করার বিধান রয়েছে।সে যাহোক,আপনি নিজেই এখন ওর ধর্মানুরাগের লক্ষণ দেখবেন।রাতের বেলাতেও শাঁখা খুলে শোবেনা। বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত সিঁদুরের দাগ একটুকুও ফিকে হতে দেয়নি।এখন দরজা খুললে আপনি নিজেই দেখতে পাবেন।’

‘আমি এক্ষুণি আসছি বাবা’ ধীরে ধীরে কোনমতে বললো অরু। দুই বাবা সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে গেলেন যে কাকে সম্বোধন করা হলো।

‘তাই হবে হয়তো। শরীর খারাপ ছাড়া এই ব্যবহারের আর কোন ব্যখ্যা থাকতে পারে না। আশা করি বড় কিছু নয়। তবে বাড়ির বৌদের সামান্য শরীর খারাপটারাপ থাকলেও একটু আপোষ করেই নিতে হয়। নইলে বাকি সবার কাজের কেমন ব্যাঘাত ঘটে দেখতে পাচ্ছেন তো?’

‘শ্বশুরমশায়কে ভেতরে আসতে বলবো?’ বাবার গলার স্বরে অস্থিরতা

‘না!’

অরুর দরজার সামনে একটা অস্বস্তিকর নিরবতা।ওপাশের দরজার সামনে নিরুর ফোঁপানির শব্দ শোনা যায়।

নিরু বাকিদের সাথে নেই কেন? ও বোধহয় মাত্র ঘুম থেকে উঠলো। কিন্তু ও কাঁদছে কেনো? হয়তো ওর মনে হচ্ছে অরুর বিয়েটা ভেঙ্গে যাবে এখুনি। মা আবার সারারাত ধরে কাঁদবে। বাপির হ্যান্ডব্যাগে খুঁজে পাওয়া যাবে সিগারেটের প্যাকেট, দিদির ব্যাগে মদের বোতল। মহিমা পিসি দিদির পূর্বতন প্রেমিকদের কথা তুলে তুলে খোঁটা দিতে দিতে বলবে, ‘ওই মেয়েকে কে বিয়ে করবে?’মাহিন ভাইয়া আবার বাসার সামনের রাস্তার উপর সারাদিন বসে থাকবে।

না,এখনো সেরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। অরু এখনো পর্যন্ত তার পরিবারের সুখের জন্য নিজের সব সুখ বিসর্জন দিতে রাজি আছে। এই মুহুর্তের জন্য সে শুয়ে আছে ঠান্ডা মোজাইকের মেঝের ওপর,আর এখনো পর্যন্ত কেউ সত্যিকারে তার অবস্থা সম্বন্ধে কিছুই জানে না আর এখনো সবাই আশা করছে এক্ষুনি সে উঠে দাঁড়িয়ে শ্বশুরমশায়ের জন্য দোর খুলে দেবে। এখনো পর্যন্ত সামান্য বেয়াদবি ছাড়া আর কোন ক্ষতি হয়নি। এইটুকুর জন্য কোন না কোন অজুহাত একটু পরেই দিয়ে দেয়া যাবে। এইটুকুর জন্যে কারো বিয়ে ভাঙ্গে না। এই মুহুর্তে সবচেয়ে কাজের কাজ হতো যদি সবাই একটু দরজা ধাক্কানো আর কান্নাকাটি বন্ধ করে অরুকে নিজের জন্য সামান্য একটুকু সময় দিতো। কিন্তু বাকিরা কেউ কিছু জানে না,এইজন্যে তারা চিন্তাগ্রস্থ।  আর দুশ্চিন্তাই তো সব দুর্ব্যবহারের চরমতম অজুহাত!

শ্বশুরমশায়ের গলার স্বর এবার উঁচুতে উঠলো, ‘বৌমা, কি হলো! তুমি আমাকে আর তোমার বাবা মাকে দরজার সামনে দাড় করিয়ে রেখে ঘরের মধ্যে শুয়ে শুয়ে হ্যাঁ-হু করছো কেন? তুমি কিন্তু আমাকে প্রচন্ড বিরক্তিকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিচ্ছো। আমি কস্মিনকালেও কোন ভদ্রঘরের বৌকে এমন কান্ড করতে দেখিনি। আমি খুবই বিস্মিত। আমার ধারণা ছিলো তুমি একজন বুদ্ধিমতি ও ভদ্র মেয়ে। অথচ আজ মনে হচ্ছে তুমি একেবারে কঠিন বেয়াদব। আজ সকালেই তোমার শাশুড়ি আমাকে বলছিলো যে সে তোমার চরিত্র নিয়ে নানারকম বদ কথা শুনেছে। আসার আগেই আমি তাকে বলে এলাম ওইসব গুজবে কান না দিতে। কিন্তু তোমার এই বেয়াদবি আমাকে আমার মত পাল্টাতে বাধ্য করছে! আমি তোমার পক্ষে আর কোন কথা বলতে পারবো না।তোমার সাথে তোমার অতীত নিয়ে আমি একান্তে আলাপ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি এখানে এরকম করে অকারণে আমার সময় নষ্ট করতে বাধ্য করে প্রমাণ করে দিচ্ছো যে এইসব তোমার বাবা মায়ের কাছ থেকে লুকিয়েও কোন লাভ নেই। তারাও সব জেনেশুনেই নিশ্চয়ই আমার কাছ থেকে লুকিয়েছেন। রূপ দেখিয়ে আপনারা কুৎসিত গুণ ঢাকার চেষ্টা করেছেন!আমাদের সহজ সরল ছেলেটিকে ঠকিয়েছেন!’

‘বাবা!’ মেঝেতে পড়ে থেকেই উত্তেজনার ঠেলায় কান্ডজ্ঞান হারিয়ে অরু চিৎকার করে বলতে লাগলো ‘আমি এখনই দরজা খুলছি,আমি একটু অসুস্থ। একটু মাথা ধরেছিলো,এতক্ষণ বিছানাতেই ছিলাম। এখন একটু ভালো লাগছে,আমি বিছানা ছাড়ছি। একটু দাড়ান। হঠাৎ করে কি যে হলো বুঝতে পারছি না। কাল রাতেও আমি একেবারে ঠিকঠাক ছিলাম,বাবা মা কে জিজ্ঞেস করে দেখুন। রাতেই সামান্য মাথা ধরেছিলো,পাত্তা দেইনি।আপনাকে তখনই জানানো উচিত ছিলো। ভাবলাম রাতে ঘুমালেই সেরে যাবে। কিন্তু…আমার অসুখের জন্য আমার বাবা মা কে কষ্ট দেবেননা প্লিজ। আপনি যেসব কথা বলছেন সেগুলোর কোন ভিত্তি নেই। আপনার সাথে আমি অতীত নিয়ে এর আগে বহুবার কথা বলেছি। আমার সব ছেলেবন্ধুদের সাথে আপনি নিজে দেখা করেছেন। তারা সবাই বলেছে যে কারো সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক নেই,কোনদিন ছিলোনা। আপনি এগুলা নিয়ে মাথা ঘামাবেননা বাবা।আপনি বাসায় চলে যান,আমি একটু পরেই আসছি। দয়া করে একটু মা-কে বলবেন যাতে আমাকে ভুল না বোঝেন।’

কথাগুলো মুখ থেকে বের করতে করতে অরু কোনমতে আলমারির কাছে এগুতে থাকে। সে এবার আসলেই দরজাটা খুলতে চাচ্ছে। শ্বশুরমশাইকে তার পূত্রবধূর চন্দ্রবদনখানা দেখাতে চাচ্ছে। সবাই কৌতূহলে এতো ফেটে পড়ছে যে অরুর এখন সত্যি দেখতে ইচ্ছে করছে যে তাকে দেখার পরে সবাই মিলে কি এমন করে উলটে ফেলবে!

সেগুন কাঠের মসৃণ আলমারি বেয়ে উঠতে একটু কষ্ট হলেও অরু আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়।কোমরে আর কব্জিতে মারাত্মক ব্যাথা-তবু সেদিকে মনোযোগ দেবার মতন অবস্থা এখন অরুর নেই। সে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াতেই বাইরে শ্বশুরমশায়ের কথা শুনতে পায়।

‘আপনারা কি ওর কথার একটা লাইনও বুঝেছেন? ও কি আমাদের সাথে মস্করা করার চেষ্টা করছে? এভাবে দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে পাগলের প্রলাপ শোনানোর মানে কি?’

‘হে ঠাকুর’-মায়ের গলার স্বর শুনেই বোঝা গেলো যে মহিলা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে।‘মেয়েটার হয়তো খুব অসুখ করেছে আর আমরা ওকে অকারণে কষ্ট দিচ্ছি।নিরু!এই নিরু!’

‘আজ্ঞে মা!’-দরজার ওপার থেকে ডাক শুনলো নিরু। অরুর ঘরকে মাঝখানে রেখেই তারা দুইজন কথা বলছে।‘দৌড়ে ডাক্তার আংকেলকে ডেকে নিয়ে আয়!অরু খুব অসুস্থ!দৌড়ে যা!শুনছিসনা অরু কেমন জ্বরের ঘোরে উল্টোপাল্টা বকছে!’

‘জ্বরের ঘোরে কেউ এতো জোরে চিৎকার করে না! শুধু পাগল ছাগলই এমন চিৎকার করে উল্টোপাল্টা বকতে পারে। মেয়ের নির্ঘাত মাথায় সমস্যা আছে!’ মার কন্ঠে যতটা উত্তাপ শ্বশুরের কন্ঠ ততটাই নিরুত্তাপ।তিনি পাগল মেয়ে গছিয়ে দেয়ার অপরাধে বেয়াই বেয়ানকে অভিযুক্ত করতে ব্যস্ত।

‘শিউলি!এই শিউলি!’-কাজের মেয়েকে ডাকছে বাবা। ‘একজন তাল-চাবিওলা নিয়ে আয় এক্ষুণি-দৌড় দে!’

মুহুর্তে দুইজন বালিকা বেলীফুলের গন্ধ ছড়িয়ে সদর দরজা দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো। হাট করে দরজা খুলে যাবার শব্দ পাওয়া গেলো!

দরজা বন্ধ করার শব্দ শোনা গেলোনা। দরজা তাহলে ওরা খুলে রেখেই চলে গেছে। দরজা খুলে রাখা বড় অমঙ্গলের কাজ!কেউ মারা গেলে-মরাবাড়ির দরজা হাট করে খোলা থাকে।

বাইরের ধুদ্ধুমারের তুলনায় অরু বরঞ্চ এই সময়ের মাঝে আরও শান্ত হয়েছে। ওদের কাছে অরুর কথাকে প্রলাপ মনে হচ্ছে। যদিও নিজের কাছে তার কথাগুলো পানির মতন পরিস্কার! হয়তো বুকের কথা মুখ দিয়ে বের হতে গিয়ে মগজের হস্তক্ষেপে এবড়ো থেবড়ো হয়ে যাচ্ছে। তবে কমপক্ষে সবাই এতোটুকু তো বুঝতে পারলো যে ওর কিছু একটা হয়েছে আর ওর সাহায্য দরকার। যাক তবু তো ভালো। কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে আবার বধূর বদলে মানুষ মনে হচ্ছে তার। তার জন্য ডাক্তার ডাকা হচ্ছে-তালা চাবিওলা খোজা হচ্ছে। এইবা কম কিসে!

এখন যা-ই বলা হবে সেটাই হবে চরমতম গুরুত্বপূর্ণ।কাজেই,কন্ঠস্বর যথাসম্ভব পরিস্কার করার জন্যেই অরু একটু কাশলো। মায়ের উপদেশ মান্য করে আওয়াজ নিচু রাখলো,যাতে গুরুজনেরা শুনতে না পান। ততক্ষণে পাশের ঘরে একটি অপার্থিব নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। গুরুজনেরা সবাই সম্ভবত দরজায় কান লাগিয়ে অরুর পরবর্তী বক্তব্য শোনার জন্যে উৎকর্ণ হয়ে আছে।

‘শুনুন’ বাবার গলায় আনন্দ স্পষ্ট। ‘দরজার নব ঘোরানোর শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।‘

‘সাবাশ অরু!’ মায়ের কন্ঠে অবিশ্বাসের আতিশয্য! যেন দরজা খোলার চেয়ে বড় কোন কাজ অরু কখনো করেনি!

‘পারবি মা!তুই পারবি,একটু কষ্ট কর,আরেকটু সহ্য কর।’ শতশতাব্দি ধরে বঙ্গীয় নারীসমাজের আপ্তবাক্য-আরেকটু সহ্য কর।

মনে মনে অরু বললো-যাক,তাহলে দরজাটা আর ভাঙ্গা লাগলো নাহ। তালাচাবিওলারও দরকার পড়লো না।

দরজাটা ভেতরের দিকে খোলে।তাই পুরোপুরি দোর খোলার আগে অরুকে দেখা গেলো না। যখন দেখা গেলো তখন শ্বশুরমশায়ের মুখ থেকে সজোরে ‘হে ঠাকুর!’ ধ্বন্যাত্মক একটা জান্তব আওয়াজ বেরিয়ে এলো। এবারে অরুও শ্বশুরমশায়কে দেখতে পেলো।তার দুহাত মুখের ওপর। অতি বিস্ময়ে গাল ঝুলে পড়েছে। অরুর মা হতভম্ভ ও হতবুদ্ধি হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো। তার দৃষ্টিতে আতঙ্ক আর লজ্জার এক অপূর্ব সংমিলন ঘটেছে।

তবে বাবা মুখভঙ্গি কিছুটা ভিন্ন। অর্ধনগ্না,উন্মাদবৎ ও রক্তমাখা কন্যাকে দেখে তার বরঞ্চ মুঠো শক্ত হয়ে এসেছে। তিনি কন্যাকে ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে তাকে এহেন বেয়াদবির জন্য একচোট শিক্ষা দেবার কথা ভাবছেন। তবে ইস্পাতকঠিন সেই দৃষ্টির মাঝে চোখের মনিটি একটু ভয়ে কেঁপে গেছে।সবচেয়ে আদিম অকৃত্রিম আবেগ-ভয়! এই ঘরটিকে এখন সেই আদিম অকৃত্রিম ভয় জাপটে ধরেছে।

তবে অরুর খুব একটা ভাবান্তর হলোনা। অর্ধনগ্নিকা সদ্যবিবাহিতা অর্ধোন্মাদিনী ঘরে ফিরে যাবার চেষ্টা করলো না। সে বরং দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। তার দুচোখে হাজার শতাব্দির বাঙালি সংস্কৃতির ক্লান্তি ভর করেছে।

ইতোমধ্যে বেলা গড়িয়েছে। গাড়ির হর্ন আচ্ছাদিত করেছে পাখির কলরবকে। সোনালী আলো সাদা হয়েছে। করিডোরের সরু জানলা দিয়ে আকাশ দেখা যায়না। একটা ইংরীজি মিডিয়াম স্কুল দেখা যায়। স্কুলের বাচ্চারা পড়ে ব্রিটিশ কারিকুলাম। বাঙ্গালিত্বের ছোঁয়া বিবর্জিত। এরা পরিচয়হীন-বাবা বলেন। নিজের সংস্কৃতি-তা যেমনই হোক-নিজের পরিচয়। নিজেরটাই শ্রেষ্ট। তাই নাস্তার টেবিলে বাবা সবসময় বাজাবেন রবীন্দ্রসংগীত-মায়াবন বিহারীণী হরিণী। হরিণীকে জয় করবে শিকারী। তাকে ধরবার পণ করবে। নারী ছলনাময়ী-ছলাকলা করবে সে।

সিংহী হয়ে শিকারীকে শিকার করা তার পক্ষে দোষনীয়।

এখনও বৃষ্টি পড়ছে। রোদ আর বৃষ্টি একসাথে। ভালুকের জ্বর। ছোটবেলায় অরু খুব চমৎকার ছড়াগান করতো। একবার ফার্স্ট প্রাইজও পেয়েছিলো। সেইটা বাধাই করা ছবি ঝুলছে বসার ঘরে। ঠোঁটে তা আত্মদাম্ভিক হাসি। যেন চাইলেই সে জয় করতে পারে বিশ্বকে।

দরজাটা এখনো হাট করে খোলা। সিড়ি দেখা যাচ্ছে। সিড়ির মুখে অরুর বিয়ে উপলক্ষ্যে নিরুর আঁকা আল্পনাটাও দেখতে পাচ্ছে অরু।

‘আচ্ছা’- অরু জানে যে এই মুহুর্তে এই ঘরে শুধুমাত্র সে-ই সচেতন অবস্থায় আছে। ‘আমি এক্ষুনি রেডি হয়ে নিচ্ছি,একটু ব্যাগটা গুছিয়ে নেবো আর এরপরই রওনা দেবো। আমাকে একটু পাঁচটা মিনিট সময় দিন শ্বশুরমশাই! আপনাকে দেখিয়ে দিচ্ছি যে আমি মোটেই আলসে বা পাগল কোন মেয়ে নই। আপনাদের ঘরে বৌয়ের জীবন হয়তো একটু কঠিনই হয়ে যাচ্ছে আমার মতন স্বাধীনচেতা মেয়ের জন্যে কিন্তু এছাড়া আমি বাবা মার মুখে হাসি ফুটাতে পারবো না। আপনি তাহলে শাশুড়ি মা-কে দয়া করে সবটা বুঝিয়ে বলবেন।নাহলে তিনি আবার এই ঘটনার ভুল ব্যখ্যা দাঁড় করাবেন। হঠাৎ করে যে কেউই একটু অসুস্থ হয়ে পড়তেই পারে। ওনাকে একটু মনে করতে বলবেন কিভাবে একয়টাদিন আমি একনিষ্ঠভাবে আমার সব দায়িত্ব পালন করেছি আর একটু সুস্থ হয়ে উঠলেই আমি আবার ওগুলো করতে শুরু করবো। আমি একটা অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে আটকে গেছি ঠিকই কিন্তু আমি ঠিক এর থেকে বেরিয়ে আসবো। আপনি ভালোমতোই জানেন যে আমার বাবা মায়ের সুখের জন্যে আমি ওনার ওপর কতটা নির্ভরশীল। ওনার একদিনের একটা কটুকথা আমার বাবা মা কে এক মাস পর্যন্ত ঘুমাতে দেয়না। প্লিজ আমার জীবনটাকে আরো কঠিন করে দেবেন না। শ্বশুরবাড়িতে সবাই মনে করেন যে আমি বিয়ের আগে ইউনিভার্সিটিতে সারাদিন মদ খেয়েছি আর সারারাত পার্টি করেছি। আমার পূর্বতন প্রেমিকের সংখ্যা নিয়ে ননদেরা আমার সামনেই ঝগড়াঝাঁটি করে। এইটা সামান্য হিংসা ছাড়া আর কিছুই না। কিন্তু বাবা-আপনি তো একজন বিজ্ঞ মানুষ।আপনি সব জানেন এবং বোঝেন। হয়তো মা ও কখনো কখনো ননদদের কথায় কিছুটা ধন্দে পড়ে যেতে পারেন। কিন্তু আপনি ভালোমতই জানেন যে আমার চরিত্রে কোন কালিমা নেই।আমি সারাজীবনে একটা ছেলের সাথেই প্রেম করেছি এবং তার সাথে আমি এমন কোন সম্পর্কে জড়াইনি যাতে করে আপনাদের বংশের নাম খারাপ হয়। আপনারা এর প্রমাণ পর্যন্ত নিয়ে ছেড়েছেন।প্লিজ! বাবা! আমার কথার মাঝে চলে যাবেন না।এতোকিছুর পর এই সামান্য ঘটনার জন্য সবকিছুকে নষ্ট করে দেবেননা প্লিজ!’

কিন্তু অরু কথা বলা শুরু করবার সাথে সাথেই শ্বশুরমশায় উল্টোফিরে পালানোর পথ খুজতে শুরু করেছিলেন। আর যেতে যেতে কাঁপা কাঁপা হাত দিয়ে ঘর্মাক্ত কপাল মুছতে মুছতে পিছন ফিরে উন্মাদ পূত্রবধূর ভীষণ রূপ প্রত্যক্ষ করছিলেন। তিনি খুব আস্তে হাটছিলেন-যেন কোন শক্তি তাকে ঘর থেকে বের হতে বাধা দিচ্ছে। তবে দোর দিয়ে বের হতেই হঠাৎ তার শরীরে দুনিয়ার শক্তি ভর করলো। সিড়ি দিয়ে সন্ত্রস্তপদে দুদ্দাড় করে নেমে গেলেন ভদ্রলোক।

অরু বুঝতে পারছিলো যে এরকম অবস্থায় শ্বশুরমশায়কে চলে যেতে দেবার প্রশ্নই আসেনা। এইটুকু ঘটনার প্রভাব হয়তো অরুর বাবা মা ঠিকমতো বুঝতেই পারছে না!তাদের ধারণা তাদের কন্যা শ্বশুরালয়ে মহাসুখে আছে। তেমনটা ভাবাই স্বাভাবিক কারণ অরুর কাছে তারা তেমনই শুনেছে। তাছাড়া বাবা মার টেনশন করার আরো বহু বিষয় আছে। তারা বর্তমান নিয়েই এতো দুশ্চিন্তিত যে ভবিষ্যতের কথা ভাবার সময় তাদের নেই। তবে সবাইকে খুশি রাখতে গেলে অরুকে অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যত সবকিছু নিয়ে ভাবতে হবে। শ্বশুরমশায়কে এখন আটকাতে হবে,ঠান্ডা করতে হবে,বুঝাতে হবে আর অতঃপর তার মন জয় করতে হবে। অরুর পরিবারের ভবিষ্যত এটার উপর নির্ভর করে।

অরু চেষ্টা করলো তার শ্বশুরমশায়ের পেছন পেছন দৌড়ে যেতে।কিন্তু চেষ্টা করতেই হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো সে। মাটিতে মাথা ঠুকে গিয়ে প্রচন্ড ব্যাথা পেলো অরু। মাথার একদিকে একটু থেতলেও গেলো হয়তোবা। এমন হচ্ছে কেন? নিজের শরীরকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না অরু।

‘হে ঠাকুর! এই অরুর বাবা-অরুকে একটু ধরো। মেয়েটা ব্যাথা পাচ্ছে তো-কষ্ট পাচ্ছে তো’-মায়ের কন্ঠে হাহাকার। মা আজন্ম ভীতু মানুষ। আজকের এই ভয়াবহ ঘটনায় সে বরং আরো বেশি ভয় পেয়ে গেছে। প্রথমে অরুকে দেখেই সে ভয়ে লাফিয়ে সরে আসতে গিয়ে মাংসের বাটি উলটে দিয়েছে। মাংসের ঝোল গড়িয়ে পড়ছে বহুমূল্য কার্পেটে। অন্যদিন নিরু কার্পেটে একদানা ভাত ফেললেও ঘরে লংকাকান্ড ঘটে যায়-তবে আজ তার কার্পেটের দিকে খেয়ালই নেই।

‘মা,ও মা! মাগো!’ প্রথম বুলির মতন পরম মমতা আর স্নেহে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো অরু। শ্বশুরের কথা তখন তার মনেই নেই বরং মাংসের ঝোলের কার্পেটে গড়িয়ে পড়া দেখে সে বেশি অভিভূত।

অরুর কান্নাভেজা আর্তনাদ শুনে মা বাপিকে জড়িয়ে ধরলো। অরু জীবনে কখনো মাকে বাপিকে জড়িয়ে ধরতে দেখেনি-এই প্রথম। তবে এখন তার বাবা মায়ের রোমান্স দেখার সময় নেই। তার শ্বশুরমশায়কে আটকাতে হবে। ভদ্রলোক এতোক্ষণে সিড়ির গোঁড়া পৌঁছে গেছেন। তার দুদ্দাড় করে নামার শব্দ গোটা সিড়িঘরে অনুরণিত হচ্ছে।

অরু দৌড়ে পিছনে যাবার চেষ্টা করলো-কিন্তু ততক্ষণে আর কোন লাভ নেই।

শ্বশুর আসলেই চলে গেছে-এটা বুঝতে পেরে বরং অরুর বাবা উলটো ক্রোধে উন্মাদ হয়ে গেলো। শ্বশুরের পিছনে পিছনে গিয়ে তাকে আটকানো এমনকি অরুকে সাহায্য করার বদলে টেবিলে রাখা খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে গোল করে পাকিয়ে অরুর দিকে তেড়ে এলেন। তার ভাবসাব দেখে মনে হলো ছোটবেলার মতন করে তিনি অরুকে পিটিয়ে তক্তা করে দেবেন। অরু যতই করুণ স্বরে কেদে কেদে বাবার ক্ষমা ভিক্ষা করে-বাবা ততই বেগে তেড়ে আসে। শ্বশুর তাড়ানো মেয়ে অরু-তার কোন দয়ামায়া প্রাপ্য নেই।

বাবা এগিয়ে আসতে লাগলেন। আজ অরুকে তিনি পিটিয়েই সোজা করে দেবেন। অরু ভয়ে উলটো ঘুরে ঘরে ফিরে যাবার চেষ্টা করলো। সেই ছোটবেলা থেকেই অরু বাবার মারকে অনেক ভয় পায়। বাবা খুব রেগে গেলে ফোস ফোস করে ঘন ঘন নিশ্বাস নেয়। ফোস ফোস শব্দ শোনা যাচ্ছে। অরুর বড় ভয় হয়।

অরু ভয়ে চিৎকার করে কেদে দিলো। কাঁদতে কাঁদতে সে হামাগুড়ি দিয়ে কোনমতে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লো। সাথেসাথে অরুর বাপি ঘরের বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি লাগিয়ে দিলেন।

অরু বাপির ভয়ে গুটিশুটি মেরে খাটের নিচে লুকিয়ে মুখ চেপে ধরে আতঙ্কে কাঁদতে থাকে। সেই কান্নার শব্দ বাইরে শোনা যায়না।

অনেকক্ষণ পর রায়বাড়ির সরগরম বন্ধ হয়ে চারিদিক কেমন একটা ভোঁতা নিরবতা নেমে এলো।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

অরু যখন নোনাজড়া ঘুম ভেঙ্গে উঠলো তখন প্রায় সন্ধ্যা। কিসের একটা ভোঁতা শব্দ বোধহয় শোনা গেলো বাইরে। শব্দটা না হলেও অরু উঠে যতো। কত ঘুমাবে আর? মাঝে বোধহয় এক মাস কেটে গেছে।

দরজার সামনে শুয়েই ঘুমিয়ে গিয়েছিলো অরু। আস্তে আস্তে দরজায় হেলান দিয়ে উঠে বসে সে। মাথাটা কাঠের মাঝে ঠেকিয়ে সে আরেকবার ভেবে দেখে আজকে সকালে কি হয়েছে! সব কি কল্পনা ছিলো-নাকি বাস্তব?

বাস্তবই। কারণ অরুর হাত পুরো রক্তে ভেজা। মাথার মাঝে খুব তীক্ষ্ণ একটা ব্যাথা। ব্যাথাটা যেহেতু সত্যি ঘটনাটাও নিশ্চিত সত্যি। তবু মাথাটা যে ভাঙ্গেনি এই বেশ কম নয়-যেভাবে পড়েছিলো অরু! জান যায়নি এই ভাগ্যি।

দরজার কাছে আসতেই অরুর নাকে কেমন একটা গন্ধ ভেসে এলো। খাবার! ইশ! এতো ব্যাথার মাঝেও অরুর মুখে একটু হাসি ফুটলো। আহারে! কতোদিন খায়না অরু। কতোদিন!

দরজার পাশে একটা বাটিতে টেংরা মাছের ঝোল আর ঠান্ডা ভাত। টেংরা মাছের ঝোল সবচেয়ে পছন্দ অরু। নিশ্চয়ই নিরু রেখে গেছে। মেয়েটা অরুকে খুব বেশি কাছের থেকে চেনে। নিরু খুব ভালো করে জানে যে যত সমস্যাই থাক-টেংরা মাছের ঝোল থাকলেই অরুর সব মুশকিল আসান।

কত্তোবড় মাছ একটা। অরুর মাথার সমান সাইজ। নিরু ইচ্ছা করে বড়োটা দিয়েছে। বিয়ের আগে প্রতি শুক্রবার বাসায় আয়োজন করে টেংরা মাছের প্রদর্শনী হতো। বাবা টেংরা মাছ কিনে এনে সবচেয়ে বড়টা বের করে মেঝেতে রাখতেন। তাই দেখে প্রতিবার অরু একই রকম উচ্ছ্বাস নিয়ে বলতো-বাবাগো! এতো বড় টেংরা মাছ আমি জীবনেও দেখিনি।

কিন্তু আজ টেংরা ভাল্লাগছেনা। কেমন যেন গন্ধ করছে। তরকারি এখনো গরম-কাজেই পচে যাবার সম্ভাবনা নেই-তবু কেমন যেন লাগছে অরুর। এক গ্রাসের বেশি খেতেই পারলোনা সে। রীতিমতো নিজের সাথে যুদ্ধ করেই সে আস্ত টেংরা মাছ-অলা ভরা প্লেটটা এঁটো করে পাশে রেখে দিলো।

দরজার ফাঁকা দিয়ে বসার ঘর দেখা যাচ্ছে। বসার ঘরের টিউবলাইটটার ভোল্টেজ কম। আজকে আলোটা দপদপ করে লাফাচ্ছে। এম্নিতে ওইখানটাতে বসে বাপি খবরের কাগজ পড়ে। খুব উত্তেজনাকর কিছু পেলে মায়ের হাতে দিয়ে বলে-পড়ো দেখি জোরে জোরে-আমরা সবাই শুনি। স্বামীর মুখে হঠাৎ পড়তে হবে-আদেশ শুনে মাস্টার্স পাশ মায়ের অক্ষরজ্ঞান উলটেপালটে যায়। আইসক্রিমকে আসক্রিম বলে মা-আর বোতলকে বলে বতোল। তাই নিয়ে কতো হাসাহাসি। অবশেষে পাঠের ভার পড়ে নিরুর উপর। মেয়েটার কন্ঠ ভারী মিষ্টি।

সবাই মিলে খুব সুন্দর গোছানো একটা সংসার। এইসবার মধ্যে খালি অরুই কেমন যেন একটু বেখাপ্পা-বেমানান। বেয়াড়াপনা করে সারাজীবন সংসারের সব অশান্তি টেনে এনেছে সে।তাইতে সবশেষে সব ছেড়েছুড়ে বাপ মায়ের মর্জিমাফিক সংসার পেতে একটু এই গোছানো সংসারে আলো আনতে চেয়েছিলো।

ক্ষণিকের জন্যে সত্যিসত্যি সেটা আনতে পেরে অরুর গর্বের শেষ ছিলোনা।

কিন্তু এখন? এক সকালের কয়েকটা ঘটনার কারণে ধীরে ধীরে এতো কষ্ট করে সাজানো শান্তির তাসের ঘর ভেঙ্গে ছত্রখান হয়ে যাবে?

এই নিয়ে ভাবতে গেলেই কেমন মাথাটা গুলিয়ে ওঠে অরুণিমার। তাই সে একটু উঠে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে ঘরের মধ্যেই ধীরপদে পায়চারি করার চেষ্টা করে।

একসময় ঘরের ওপারের দরজা একটু ফাঁকা হয়েই আবার সন্তপর্ণে বন্ধ হয়ে যায়। কেউ হয়তো ঘরে আসতে চাইছিলো-কিন্তু শেষ মুহুর্তে আর আসলোনা। অরু ধীরে গিয়ে দরজা ঘেষে দাঁড়ায়। তার ইচ্ছে করে একবার ডাকে-কে ওখানে? কিন্তু সাহস হয়না। এখন সবাই তাকে এড়িয়ে চলছে। কাল সকালেও যখন সে লক্ষ্মী মেয়ে ছিলো তখন সকলে একবার দরজা খুলে তাকে দেখবার জন্যে জীবনপাত করে দিচ্ছিলো-আর এখন তার দরজা হাট করে খোলা-তবু কেউ তাকে দেখতে চায়না। বরং দরজার ওপারে আস্তে করে ছিটকিনি লাগিয়ে দেবার শব্দ শোনা যায়।

অলক্ষ্মীকে কেউ চায়না।

রাত আরেকটু বাড়তেই কারেন্ট চলে গেলো। এবার প্রথম অরু একটু সবার ফিসফাস শুনতে পেলো। সবাই মিলে পা টিপে টিপে এঘর ওঘর করে বেড়াচ্ছে আর বুদ্ধি আটছে যে এই অলক্ষ্মী মেয়েকে নিয়ে কি করা যায়! যাহোক-এতোটুকু বোঝা যাচ্ছে যে কালকে সকালের আগে আর কেউ অরুর ঘরে আসছে না।

সেটাও বেশ একটা খারাপ না। ভালো একটা সময় পাওয়া গেলো কিছুক্ষণ নিজেকে নিয়ে ভাবার জন্যে। ঠান্ডা মেঝেতে শুয়ে থাকতে থাকতে অরু হঠাৎ নিজেকে চিনতে পারে না। এতো বছর ধরে এই ঘরে কে বাস করছে-কেন করছে? নিজেকে নিজের থেকে আলাদা করে একবার নিরিখ করে দেখতে চাইছে অরু।

নিরিখ করতেই লজ্জায় কুঁকড়ে এলো অরু। নিজের থেকে নিজেকে লুকাতেই হয়তো সে গড়িয়ে খাটের নিচে লুকিয়ে পড়তো। ছোটবেলায় লুকোচুরি খেলার সময় সে এমনি করে সবসময় খাটের তলে লুকিয়ে পড়তো। কেউ খুঁজে পেতো না। এখন দেহটা আরেকটু বড় হয়েছে-খাটের তলে আটতে চায়না। জোর করতেই আবার ব্যাথা করে ওঠে অরুর। তবু জোর করে। ব্যাথার অভাব নেই অরুর। আরেকটু বাড়লেই ক্ষতি কি?

সারারাত সে খাটের নিচেই কাটালো। কিছুক্ষণ ঘুমালোও বা-কিন্তু আবার জেগে উঠতে লাগলো তীব্র ক্ষুধার জ্বালায়। আবার কিছুক্ষণ কাটলো নিজেকে শান্ত করতে-শান্তি,শান্তি,শান্তি! সব ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে।

সকাল হতেই ওপারের দরজা খুলে নিরু এলো। মেয়েটা চমৎকার একটা থ্রীপিস পরেছে। সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়েটা আজ কি ভয়াবহ সুন্দরী হয়ে গেছে। দেখলেই চোখ আটকে যায়-চোখের থেকে মায়া ঠিকরে বেরুচ্ছে মেয়েটার।

নিরু ঘরে ঢুকেই অরুকে দেখতে পেলোনা-কারণ অরু ছিলো খাটের নিচে। পুরোপুরি নগ্ন অবস্থায় কুকুরকুন্ডলী হয়ে রক্ত আর ময়লায় মাখামাখি হয়ে শুয়ে ছিল অরু।খাটের নিচে অরুকে এই বিভৎস কদর্য অবস্থায় দেখে নিরু পুরো আৎকে উঠে দৌড়ে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলো।

বের হতেই বোধহয় মেয়েটার অনুশোচনা বোধ হচ্ছিলো কারণ কিছুক্ষণের মাঝেই সে ফিরে এলো। অরু খাটের কোনা দিয়ে ঘাড় বের করে নিরুকে দেখে। নিরু কি দেখবে যে অরু কালরাতে কিছুই খায়নি?

নিরু যদি না দেখে তাহলে অরুর এখন বেরিয়ে পড়ে অরুর পায়ে পড়ে ওর কাছে খাবার জন্যে ভালো কিছু একটা চাইতে হবে।খিদেয় তার মারা পড়ার উপক্রম।

তবে সৌভাগ্যক্রমে নিরু দেখলো যে অরু টেংরা মাছের থালা এঁটো করে ছড়িয়ে রেখে দিয়েছে। নিরু ধৈর্য ধরে পুরো জায়গাটা ন্যাকড়া দিয়ে পরিস্কার করে নিয়ে গেল।

অরু পুরো অন্তর দিয়ে অপেক্ষা করছিলো টেংরার যায়গায় নিরু নতুন কি আনে সেটা দেখার জন্যে। সময়টা কাটানোর জন্যে সে কল্পনাও করতে লাগলো যে নিরু কি কি আনতে পারে। কিন্তু নিরু যা নিয়ে আসলো-সেটা অরু স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনাই।নিরু রীতিমতো ঘরের সব খাবার তুলে এনেছে-অরুর কি খেতে ভালো লাগে সেটা দেখবার জন্যে। মাংস, সবজি,কাচা টমেটো,নুডুলস,গরম ভাত,পান্তা ভাত,বাসি মাছের তরকারি,টকে যাওয়া ডাল;সবকিছুর সাথে এক গ্লাসে জল-অরুর গ্লাসে-অরুর ছোটবেলাকার গ্লাসে।

ছোটবোনের সামনে নিশ্চয়ই নগ্ন বড়বোন খাটের নিচ থেকে বের হবেনা-এই সুবিবেচনায় নিরু সব রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। যাবার সময় বাইরে থেকে সন্তপর্নে ছিটকিনিও তুলে দিলো সে।

শান্তিতে অরুর চোখে পানি চলে আসলে। শেষমেশ খেতে পাবে সে।

ব্যাথাট্যাথাগুলো একটু সেরে গেছে-তাই নড়াচড়া করতে এখন আর বিশেষ সমস্যা হচ্ছেনা।একেবারে আয়েশ করে পেট ভরে খাবে সে এখন।

এক নিশ্বাসে হাভাতের মতন করে অরু পান্তাভাত,বাসি তরকারি আর টকে যাওয়া ডাল দিয়ে খেয়ে নিলো। দিনকে দিন শ্বশুরবাড়িতে সবার খাওয়ার পরে রয়ে যাওয়া বাসিটুকু খেতে খেতে এখন ওগুলোই ভালো লাগে তার। টাটকা খাবার একটুও মুখে রুচলো না তার। এমনকি সেগুলোকে একটু দূরেও ঠেলে দিলো অরু। গন্ধটা অসহ্য লাগছিলো।

খাবার পর অনেকক্ষণ অরু হাত পা ছড়িয়ে ওখানেই শুয়ে থাকলো। একসময় নিরু আবার আস্তে করে ছিটকিনিটা খুলে ঘরে এলো।

ছিটকিনি খোলার শব্দ শুনে আধাঘুমের মধ্যেই হঠাৎ চমকে গিয়ে তাড়াহুড়া করে খাটের নিচে ঢুকতে গিয়ে অরু আবার মাথায় ব্যাথা পেলো।কিন্তু এবার ওই ছোট্ট জায়গাটাতে ঢুকে থাকতে তার একটু কষ্টই হলো। খেয়েদেয়ে একটু ফুলে যাবার পরে ওই চিপাটুকুতে বসে থাকতে আরো কষ্ট হচ্ছিলো। দমবন্ধ ভাব সহ্য করতে করতে অরু দেখলো কিভাবে করে দুইবোনের মাঝে লক্ষ্মী বোনটা বজ্জাত বোনটার ছড়ানো ছিটানো নোংরাটুকুন ফুলঝাড়ু দিয়ে মুছে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটার মাথায় বুদ্ধিও অনেক-কারণ সে খুব তাড়াতাড়ি কাজটুকু করে চলে গেলো। সে যেন বুঝতে পারছে যে খাটের নিচে লুকিয়ে দিদির অনেক কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কাজ সেরে নিরু বেরিয়ে যাবার পরই অরু খাটের নিচে থেকে বের হয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচল।

অরু এখন থেকে রোজ এমন করেই খাবার পেতো। সকালে একবার-যখনও কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি আর রাতে একবার-যখন সবাই ঘুমিয়ে গিয়েছে। বাবা মা-ও কখনো চাইতো না যে অরু অভূক্ত থাকুক-কিন্তু তবু হয়তো অরুর প্রতি অত্যধিক ভালোবাসাই তার এই রূপান্তরের প্রতি তাদের অত্যধিক ঘৃণার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। তারা বরং নিরুর মুখে এর গল্পটুকু শুনেই যথেষ্ট শিহরিত। কে জানে-হয়তো নিরুও চেয়েছিলো যাতে বাবা মাকে একই রকম তীক্ষ্ণ যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে না হয় যেটা সে রোজ ভোগ করছে। ওরা এম্নিতেই অনেক কষ্টে আছে।

অরু কখনো জানতে পারবেনা যে তালা চাবিওলা বা ডাক্তারকে বাপি-মা কি বলে ভাগিয়েছে কারণ তাদেরকে সত্যিকারের কথা বলে কোনই লাভ নেই। সবাই একদানে পাগল বলে ছেড়ে দেবে। তাই সমাজের প্রতি বাপি মায়ের বক্তব্যকে অরুর নিরুর দীর্ঘশ্বাস আর প্রার্থনার মাঝে খুঁজে নিতে হতো।  খাবার দেবার সময় নিরু এইটুকু শব্দই করতো-দীর্ঘশ্বাস আর প্রার্থনা। আর বের হয়ে মা কে বলতো-খেয়েছে

অথবা কোন কোন দিন আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে বলতো-খায়নি।

অরু কখনো এর বাইরে পরিবারের আর কোন সমাচার শুনতে পায়নি। সারাটাদিন একটু ফিসফাস শুনলেও সে দরজায় কান পেতে থাকতো। খুব কদাচিৎ একটা দুইটা কথা শোনা যেত। সব কথার মূল কথা একটাই-এখন আমরা কি করবো?আর যতক্ষণ তারা কথা বলতো-তারা কথা বলতো তিনজনের একটা পরিবারের মতন।

কাজের মেয়েটা প্রথমদিনই চলে গিয়েছিল। সে যতটা দেখেছে-তা দেখার পর আর এই বাড়িতে কাজ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তার নানী বলেছে যে পাগল লোকের আশেপাশে থাকলে সন্তান পাগল হয়। সে এখন পোয়াতী-কাজেই এখন তার পক্ষে এইবাড়িতে কাজ করা সম্ভব না। তবে সে যথেষ্টই বিশ্বস্ত-মাথার দিব্যি দিয়ে গেলো যে বাপের জন্মে কাউকে বড়আপার পাগলামির কথা বলবে না।

এখন নিরুকে রান্নার কাজেও হাত লাগাতে হতো। যদিও রান্না না করলেও খুব একটা এসে যেতো না কারণ কেউই খেতো না। অরু প্রায়ই শুনতো-ওরা একজন আরেকজনকে ক্লান্ত গলায় খেতে বলছে আর সবাই সবার উত্তরে বলছে-খেতে ইচ্ছে করছে না।

প্রথম দিন ফুরোনোর আগেই বাবা অরুর মা আর নিরুকে সমস্ত বুঝিয়ে বলেছেন। বাবা ডাক্তার আংকেলের সাথে গোপনে কথা বলেছেন। রোগের সমস্ত লক্ষণ আর উপসর্গ বলেছেন। অরুকে সামনাসামনি না দেখে চূড়ান্তভাবে কিছু বলা যাচ্ছেনা কিন্তু ডাক্তার আংকেলের ধারণা অরুর বাইপোলার ডিসঅর্ডার হয়েছে। এটা একটা মানসিক রোগ। কঠিন মানসিক চাপের কারণে এই রোগ হতে পারে। রোগীর হঠাৎ চূড়ান্ত মন খারাপ-আবার কখনো চূড়ান্ত মন ভালো হতে পারে। ডায়াবেটিসের মতন কখনও এই রোগ ঠিক হয়না-কিন্তু ওষুধে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। কিন্তু সমস্যা হলো এই রোগে আক্রান্তরা ভয়াবহ বিষণ্ণ হয় আর যেকোন মুহুর্তে আত্মহত্যা করতে পারে।

এই রোগের কোন ওষুধ নেই-আর রোগটা কখনও সারেনা। তার মানে দাঁড়ায়,যে অরু সারাজীবনের জন্যে পাগল হয়ে গেছে। এই পাগল মেয়েকে কি আর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ফেরত নেবে?

সেদিনের ঘটনার পরের থেকে দীর্ঘদিন শ্বশুরবাড়ির সাথে অরুর বাবা মায়ের কোন যোগাযোগ নেই। অরুর বাবা বেশ কয়বার ফোন করে ক্ষমা চাইতে চেয়েছিলেন কিন্তু কেউ ফোন ধরেনি। অরুর মা মাঝেমাঝেই অরুর বাবাকে বলেন এক বাক্স মিষ্টি নিয়ে বেয়াইবাড়ি চলে যেতে-কিন্তু বাবার সাহস হয়না। বাবার মেজাজ বড় চড়া-অপমান সহজে সহ্য করতে পারেন না। তার ভয় হয়-শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা কোন একটা দুর্বব্যহার করলে যদি তিনি রাগের মাথায় উল্টোপাল্টা কিছু বলে বসেন-তাহলে মেয়েটার বিয়েটা হয়তো সত্যিই পুরোপুরি ভেঙ্গে যাবে।

এখনো বিয়েটা টিকে আছে সরু একটা দড়ির উপর। দড়ি হলো জামাই। এতোসবের পরেও কোন কারণে অরুর স্বামী দেবব্রত অরুর ব্যাপারে হাল ছেড়ে দিতে নারাজ। সে প্রায়শই ফোন করে অরুর বাবার কাছে অরুর হালচাল জানতে চায়। এই কাজটি করতে তার নিজের বাবা তাকে বারবার নিষেধ করেছে-কিন্তু তবু বাবার নিষেধ অমান্য করে ছেলেটা ফোন করে। ছেলেটা অরুকে সত্যিই বড় ভালোবাসে!

অরু সব শুনতো।

ওর বাবা আর মা মিলে আলোচনা করতো যে অরু যদি কখনও ঠিক না হয় তাহলে নিরুরও বিয়ে হবেনা। অরুর বিয়ে নিয়ে আর আশা করে লাভ নেই-সব ঈশ্বরের হাতে ছেড়ে দেয়াই কর্তব্য।কিন্তু নিরুটাকে যেভাবে হোক তাড়াতাড়ি পার করতে হবে। যদি কোনভাবে তার আগেই অরুর বিয়েটা ভেঙ্গে যায়-তবেই সর্বনাশ। নিরুর জন্য আর ছেলে পাওয়া যাবেনা।অরু সবসময় বাপি মাকে বোকাসোকাই মনে করেছিলো। কিন্তু এক্ষেত্রে তাদের বুদ্ধির ঝলক দেখে অরু মুগ্ধ না হয়ে পারলো না।

বাবা মায়ের কাছে অরু ততদিনে মোটামোটি পরিত্যক্ত। এখন অরুর কাছের মানুষ বলতে কেবল নিরু। তবে নিরু যেনো অরুর ঠিক বিপরীত। অরুর যেমন কাঠখোট্টা বিজ্ঞানের বিষয়ে আগ্রহ-অরু তেমনি চারুকলায় গভীর আগ্রহী। মেয়েটা খুব ভালো ছবি আঁকে। নিরুর আঁকা ছবির দিকে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকতো অরু। বেশিরভাগ সময়ে ভার্সিটির হলেই থাকতো অরু-তবে বাসায় আসলেই নিরুর সাথে নিরুর ছবি আঁকাআঁকি নিয়ে কথা বলতো ওরা। দেশে বাবা মা কোনদিনই নিরুকে ইচ্ছামতন পড়তে দেবে না। তাই অরুর ইচ্ছা ছিলো নিরুকে প্যারিসে ফাইন আর্টস পড়তে পাঠাবে। অরু আর নিরুর কথাবার্তা প্রায়ই উত্তরার গলি ছাড়িয়ে প্যারিসের বুলেভার্ডে গিয়ে ঠেকতো। বাপি-মা এইসব আকাশ কুসুম কথাবার্তা পছন্দ করতো না,কিন্তু অরু একটু গোয়ার্তুমি করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো যে প্রয়োজনে নিজের টাকায় বোনকে প্যারিসে পাঠাবে সে। সেইজন্যে চার বছর ধরে টিউশনির টাকা জমাচ্ছিলো সে।

নিরুর জন্মদিনে সব কথা একবারে বলে সবাইকে চমকে দিতে চেয়েছিলো অরু।

কিন্তু এখন আর ওসব ভেবে লাভ নেই। এখন অরুর দিন কাটে দরজার সাথে কান ঠেকিয়ে। মাঝে মাঝে নিজের উপরই ক্লান্ত হয়ে পড়ে অরু। তখন একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে অরু। বেসামাল মাথাটা দরজায় ঘষে একটু শব্দ হয়। একমুহুর্তে পিনপতন নিস্তব্ধ হয়ে যায় বাড়িটা। নতুন করে আবার কি কান্ড ঘটাচ্ছে মেয়েটা?

তারপর আবার একসময় তারা নিজেদের কথোপকথনে ফিরে যায়।

মাকে বুঝানোর সময় বাপি প্রায়ই এক কথা বারবার বলতো। সম্ভবত মায়ের মোটা মাথায় সহজে কোন কথা ঢোকেনা বলে। বাপি একসময় ক্লান্ত হয়ে যায়। ক্লান্ত হয়ে রেগেমেগে চিৎকার করে ওঠে। কিছুক্ষণ পরে আবার সব নীরব হয়ে যায়। রাত গড়ালে আঁধার চিরে একটা তীক্ষ্ণ কান্নার আওয়াজ শোনা যায়। মা কাঁদছে।

মা সবসময় নীরবে কাঁদার চেষ্টা করে। জন্মের পরের থেকেই নিজের অস্তিত্ব নিয়ে অনেক সংকুচিত থাকে মা। বোকামি করে করে সবার পথের কাটা হয়ে থাকে বলে তার অনেক লজ্জা। সেই লজ্জা আরো বেড়ে যায় যখন মনে পড়ে যে সংসারে সে একটা কড়িও আয় করে আনতে পারেনি। রান্নার হাতও তার বিশেষ ভালো নয়। শুধু খুব সুন্দর হাতের কাজ করতে পারে মা। পুতুল-শোপিস-বালিশের ওয়াড়। পুরো বাসা জুড়ে মায়ের হাতের শিল্পের ছোঁয়া। দেখলে মনে হয় কোন বাহারী দোকানের শো রুম।

কিন্তু এতে কোন লাভ হয়নি-বরং ক্ষতি হয়েছে। ছোট মেয়েটা ঝুঁকেছে এইসব অর্থহীন আঁকিবুঁকির দিকে-পড়ালেখায় মন দেয়নাই। মা সারাজীবন শুধু ছেলেমেয়েদের অভ্যাসই নষ্ট করেছে। ছোটবেলাকার অভ্যাস রাত জেগে পড়া-সেই থেকে রাতে ঘুমাতে পারে না। তার থেকে দেখে দেখে শিখেছে ছেলেমেয়ে। সারারাত জেগে থাকে। জেগে জেগে ফোনে ইটিশপিটিশ। আর সারাদিন ঘুমানো-সব শিখেছে মায়ের কাছ থেকে। তাই মার খুব লজ্জা।

সেই লজ্জাও এতো নির্লজ্জ যে মায়ের কান্না বালিশচাপা দিতে পারেনা। চাপার ফাঁকফোকর দিয়ে চল্লিশ বছরের জমানো চিৎকার বেরিয়ে আসে। মা কাঁদলে বাসার সবাই টের পায়। অরুও। কেউ ঘুমাতে পারেনা। সবাই চোখ বুজে জেগে থাকে।

এমনিতে রাত জেগে থাকলে এসময়ে মা অরুর বাপির কাছে কঠিন ঝাড়ি খায়। আজ বাপি কিছু বলছেনা। তার চোখের কোণা থেকে জল গড়িয়ে নাকের উপর এসে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। বাপি জল মুছতে পারছেনা-কারণ জল মোছার জন্য নড়লেই মা বুঝে যাবে যে বাপি ঘুমায়নি। সাথে সাথে ভয়ে কান্না বন্ধ করে দেবে।

থাকনা-একটু কাঁদুক মেয়েটা। মেয়েটার অনেক কষ্ট।

অরুও মায়ের কান্না শোনে। সে শুনছে ছোটবেলার থেকে। তখন থেকেই মায়ের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে আসছে সে। এখনো পারেনি। কখনো পারবেনা।

পারে নিরু। তাই নিরুকে মাঝেমাঝে অনেক ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করে। এই ছন্নছাড়া লক্ষ্মীছাড়া হতভাগা সংসারে মেয়েটা আশার আলো জ্বেলেছে। আর এই অদ্ভুত রূপান্তরের পরের থেকে নিরু যা করেছে তার জন্যে তাকে কিছু বলার ক্ষমতাও নেই অরুর। ভাবলেই কেমন মাথার একপাশে ভোঁতা যন্ত্রণা হয়।

তবে নিরুর কখনো ধন্যবাদ লাগেনা-কখনো লাগেওনি। সে এতই সতর্ক যে সে জানে যে দিদির ঘরে এক মুহুর্ত বেশি থাকলেও দিদির কষ্ট করে লুকিয়ে থাকা লাগে। তাই সে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ সেরে বেরিয়ে পরতে চায়। দিদির যতটুকু দেখে ফেলে-না দেখার ভান করে। যতটুকু ভয় পায়-লুকিয়ে রাখে। যতটুকু কান্না পায়-জমিয়ে রাখে। দিদির ঠিক পাশে ঘরে থাকে বলে কখনো কাঁদতেও পারেনা নিরু। শুনলে দিদি কষ্ট পাবে।

একদিন নিরু যাবার আগে দেখলো যে দিদি খাটের কোণা দিয়ে নিষ্পলক দৃষ্টিতে বন্ধ জানালাটির দিকে চেয়ে আছে। যাবার আগে তাই জানলাটি একটু খুলে দিলো। দেখলো তখন দিদি কেমন যেন জন্তুর মতন গোঙ্গানি দিয়ে বাচ্চাদের মতন মূঢ় শূণ্য দৃষ্টিতে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে দিলো।

সেদিন নিরু মাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছে।ওই একদিনই-আর কাঁদেনি।

মাও অরুকে দেখতে আসতে চায়। কিন্তু মার সাহস নেই। কিন্তু তবু সে প্রায়ই নিরুকে বলে, ‘আমি একটু মামণিকে দেখে আসি রে? আমার ছোট্ট মেয়েটা। সেইদিনও কাদার মধ্যে পিছলে গিয়ে হাত পা ছড়িয় কাদছিলো। আজ দেখ-বড় হয়ে কতো কষ্ট পাচ্ছে। কেউ বুঝতে পারছেনা আমার ছোট্ট মেয়েটাকে। একটু বোঝ মা। আমাকে একটু যেতে দে।’

নিরু বলে, ‘যাও,তোমাকে তো আমি মানা করিনি।’

‘যাবো? পরে যদি কোন সমস্যা হয়ে যায়? যদি কিছু উল্টোপাল্টা করে ফেলি-আর অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়?’

মার সাহস হয়না। মা ভয় পায়। তারপর একদিন ঘরের দরজার সামনে আসে। তারপরের দিন ফাক করে একটু ভিতরে দেখে। তারপরের দিন বলে-নিরু,আমি যাবো আজকে।

নিরু প্রথমে ঢুকে দেখে নেয় যে সব ঠিক আছে। তারপর মা-কে ভেতরে আসতে বলে।

মা ভেতরে আসে। ঘুরেফিরে দেখে।এরপর নিরুকে জিজ্ঞেস করে-অরু কোথায়? নিরু বলে-ওই খাটের নিচে।দিদিকে জ্বালিও না।

না না,জ্বালাচ্ছি না। কিন্তু এই ঘরটা এতো ঘিঞ্জি কেন? এই ঘরে তো আলোবাতাস ঢোকারই পথ নেই। এখানে থাকলে তো সুস্থ মানুষও পাগল হয়ে যাবে।

মা! দিদি পাগল হয়নি।

ও হ্যাঁ।তা-তো বটেই! কিন্তু-তুই-ই দেখ। ঘরটা কেমন ঘিঞ্জি না? একটু খালি করে দিলেই আমার মেয়েটা আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।

কোমর বেঁধে মা আর নিরু মিলে ঘর খালি করা শুরু করলো। সারাদিন ঘরময় আসবাব টানাটানির শব্দ। এইদিকে ছোট্ট একটা খাটের তলে অরুর দমবন্ধ হয়ে মরার জোগাড়।

প্রথমে আলমারি,তারপর টেবিল,ড্রেসিং টেবিল-আয়না।

অবশেষে একসময় খাট ছাড়া সব আসবাব টেনে বের করা হয়ে যায়।

অরু এতক্ষণ খাটের ফাঁকা দিয়ে তাকিয়ে ছিলো দেয়ালের হলুদ রঙের একটা পোস্টারের দিকে। ভার্সিটির সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে নিজে ছাপিয়েছিলো সে। ফেমিনিজমের পোস্টার। একজন মহিলা হাতের পেশি ফুলিয়ে বিশ্বকে বলছে-আমরাও পারি। এমন পোস্টার বাজারে পাওয়া যায়না।

পোস্টারটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অরুর মাথার পিছনে একটা তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা হয়। কিন্তু তবু অরু চোখ সরাতে পারে না। কেমন যেন একটা দুর্নিবার আকর্ষণ। যন্ত্রণা পাবার মধ্যেই কেমন একটা অদ্ভুত শান্তি অনুভব হয়।

কিন্তু হঠাৎ অরুর দর্শন রোধ করে দাঁড়ায় অরুর মা। তিনি ঘরের দেয়াল পরিস্কার করছেন। কাজেই এই পোস্টারটিকে তিনি টেনে তুলে ফেলবেন। ঘর পরিস্কার হলে এম্নিতেই মেয়ের মাথা পরিস্কার পরিস্কার মনে হবে। তাই দেয়াল পরিস্কার করতে হবে।

দেয়াল পরিস্কার করতে যেই তিনি পোস্টারটা ধরে টান দিলেন-ওমনি খাটের নিচ থেকে অরু না-না বলতে বলতে সব ধাক্কা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে এলো। হঠাৎ করে অরুর এমন ভয়ংকর মূর্তি দেখে বোকা মা খুব ভয় পেয়ে গেলেন। ভয়ের চোটে তার হাতের টানে পোস্টার একটু ছিঁড়ে গেলো।

না…না…না…না…না…

কেমন অন্ধ পাগলের মতন সব ভুলে গিয়ে অরু ধাক্কা দিয়ে মা কে দূরে সরিয়ে দিলো। বোকা মা এমন ভয় পেয়েছেন যে ধাক্কা খেয়ে টাল সামলাতে পারলেন না। উলটে পড়ে গিয়ে দেয়ালে মাথা বাড়ি খেলেন। এরপর ভয়ে নাকি আঘাতের কারণে কে জানে-মা জ্ঞান হারালেন।

অরু তখনও সারা শরীর দিয়ে তার পোস্টারটি আগলে ধরে রেখেছে। তার গোলাপী ঠোঁট কাপছে। হাত দিয়ে পোস্টারের ফেমিনিস্টকে জড়িয়ে রেখে সে অশ্রুসজল কন্ঠে বলছে,না…না…না…

এমন সময় দরজা ঠেলে বাবা ঘরে ঢোকে। মেঝেতে মা কে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখে তার কান্ডজ্ঞান ঠিক থাকেনা।

বজ্জাত মেয়ে…বেয়াদব মেয়ে…সারা সংসার নষ্ট করিসিস,এখন মায়ের গায়ে হাত তুলিস?

থাপ্পড় খেয়ে অরু বাবার পায়ের কাছে বসে পড়ে, বসে পড়ে কেমন অব্যক্ত মূঢ় কন্ঠে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে…

বাবা,আমি…করিনি….বাবা…আমাকে…মারেনা…বাবা…আমি..ভয়…বাবা…খুব ভয়…ওরা নিয়ে যাবে আমাকে বাবা…খুব ভয় দেয়…বাবা আমাকে ওদের কাছে পাঠায়ে দিয়েনা বাবা…আমি ভালো মেয়ে হয়ে যাবো…বাবা…খুব ভালো মেয়ে…

পচিশ বছর বয়েসী মেয়ের মুখে এহেন অদ্ভুত অর্থহীন প্রলাপ শুনে বাবার মাথা আরো গরম হয়ে যায়। পা ঝামটা দিয়ে অরুকে সরিয়ে দেয় বাবা।

দূর হ…তুই…দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে…

অরু বেচারা ততক্ষণে ভয় পেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ওর খাটের নিচে গিয়ে লুকিয়ে পড়তে চাচ্ছিলো।

কিন্তু ইতোমধ্যে বাপি রাগের মাথায় অরুর দিকে ওর ছোট্টবেলাকার কাঁচের মগটা ছুঁড়ে মেরেছে। মগটা গিয়ে লাগলো অরুর  ডান উরুতে।

মাগো…মা…মা…ও মা…

বলতে কঁকিয়ে উঠে অরু তার খাটের নিচে লুকিয়ে পড়ে।

চুপ…আরেকটা শব্দ করলি গলা টিপে মেরে ফেলবো!

ভয়ে দুই ঠোঁট একসাথে চেপে ধরে একদম চুপ হয়ে যায় অরু। হাত চেপে ধরে মুখের ওপর। চুপ!একদম চুপ।

সাথেসাথে অরুর বাপি ঘরের বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি লাগিয়ে দিলেন।

অনেকক্ষণ পর রায়বাড়ির সরগরম বন্ধ হয়ে চারিদিক কেমন একটা ভোঁতা নিরবতা নেমে এলো।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

কারো আর অরুর খোঁজ নিতে যাওয়ার সাহস ছিলো না। আপাতত সবার কাছে সে একজন ভয়ংকর প্রাণি।

হয়তো তার এই ভয়ংকর প্রানি হয়ে ওঠাটাই অনেকদিন পর রায়বাড়িতে নতুন একটা ঘটনা ঘটালো। সবাইকে মনে করিয়ে দিলো যে অরুও কমপক্ষে একটা প্রাণী-শুধু একটা সমস্যার নাম নয়।

এমনকি বাপিরও অরুর জন্যে মায়া হচ্ছে। সেইদিনের পর থেকে বাপি আর ঘুমায়নি। মাথাটা ভারী হয়ে আছে।

অরু বেচারী পায়ের ব্যাথায় নড়তে পারছেনা। আর কখনো পারবে কিনা সে জানেও না। আসলে তার আর ইচ্ছাও নেই। খাটের নিচে এখন আর তার দমবন্ধ লাগে না-খাটের নিচের থেকে বের হলেই দমবন্ধ লাগে। সে শুধু খাটের এই কোনা দিয়ে আধাছেড়া ফেমিনিজমের পোস্টারটা দেখতে পায়। দিনরাত সে পোস্টারটার দিকেই তাকিয়ে থাকে।

দরজা খোলা থাকে বলে এখন খাটের নিচ থেকেও খাবার ঘরের টেবিল দেখা যায় । কিন্তু এখন আর আগের মতন করে ওরা কোন আলাপ আলোচনা করেনা। অপরাধীর মতন মাথা নিচু করে যার যার মতন দ্রুতবেগে খেয়ে নেয়-তারপর উঠে চলে যায়। খাবার মাঝে সবাই ছোট ছোট করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কখনও আলাদা আলাদা-কখনও সবাই একসাথে। পরিবার বলতে এখন এতটুকুই বেঁচে রয়েছে।

সরাসরি শারীরিক আঘাতটুকু মায়ের উপর হয়েছিলো বলেই হয়তো সে একটু বেশি দায়িত্ববোধ অনুভব করে। সেই দায়িত্ববোধের থেকে প্রতি রাতে সে বাপিকে বলে-‘অরুর বাবা,অরুকে একটু বলো না উপরে উঠে শুতে।’

বাপি এমন ভান করে যে বাপি ঘুমিয়ে গেছে। মা আরো কিছুক্ষণ বাপিকে নাড়াচাড়া করে নিশ্চিত হয়। তারপর কাঁদতে বসে।

বাপি এবার কাঁদেনা। তার বুকে পাথর। সে জানে মা তাকেই দোষারোপ করছে। জ্ঞান ফেরার পর অন্যের মুখে গল্পটি শুনলে বাপিকেই দোষী মনে হবে। কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ কি কখনো তার নিজের মেয়ের দিকে দিকে কাঁচের গ্লাস ছুঁড়ে মারে?

হয়তো মারেনা। হয়তো বাপিরই দোষ। আসলে বাপিরই দোষ। ছোটবেলা থেকে অরুকে যথেষ্ট সময় দেয়নি বাপি। অফিসের কাজে ব্যস্ত ছিলো। ছুটি পেলেও মেয়েদের সময় দিতোনা।

তারচেয়ে বড় কথা-বাপি মেয়েদের বুঝতো না। সারাজীবন খাটাখাটনি করে কেটেছে। মেয়েদের চেনার বা জানার মতন বিলাসিতা করবার সময় তার ছিলোনা।

মেয়েদের নিয়ে তার ইচ্ছেগুলো ছিলো সহজ সরল। দাদুমার কোমরে বড় ব্যাথা ছিলো-কোন ডাক্তারে সারতো না। বাবার ধারণা ছিলো-অরু যদি ডাক্তারি পড়ে এসে দাদুমার চিকিৎসা করে-তাহলে হয়তো দাদুমা সহজেই সেরে উঠবে। রোগ তো আর পুরোটা শারিরীক নয়-কিছু মানসিক।

কিন্তু মেয়েটা ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেলোনা। চান্স পেলো দূরের একটা মেডিকেলে। বাবা চেয়েছিলেন অরু সেখানেই যাক। কিন্তু অরু গেলোনা। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়বে-এপ্লায়িড ফিজিক্সই পড়বে। ঘরের থেকে গোয়ার্তুমি করে বেরিয়ে যাবার উপক্রম। শেষে বাবা মেনে নিতে বাধ্য হলো।

কিন্তু যখনই বাবা শুনতো যে তার কোন কেরানীর মেয়ে ডাক্তার হয়ে বেরিয়েছে-অথবা কোন কলিগ বলছে শরীর খারাপ হলে তার ভাতিজার কাছে চেকাপ করাতে যেতে-তখনই তার বুকের বাম পাশে একটা ব্যাথা হতো। তখন থেকেই তার বুকের ব্যাথা শুরু। ব্যাথাটা এখনও হয়। অরুর মা বারবার বলে ডাক্তার দেখাতে-অরুর বাবা দেখায়না।ডাক্তারদের উপর তার বড় অভিমান।

মেয়ের উপর কখনো রাগ করতে পারেনা বাবা। বড় আদরের মেয়ে। সেইদিন জন্মালো মেয়েটা-ধবধবে সাদা গা। শরীর থেকে যেন আলো বেরোচ্ছে। বাবা ভাবলেন-আমি তুচ্ছ মানুষ-আমার ঘরে এমন দেবশিশু এলো কোথা থেকে?

অরু যখন জন্মেছিলো তখন সূর্য উঠলো-তাই অরুণিমা নাম রেখেছিলো দাদুমা। কিন্তু বাবার বড় ইচ্ছে ছিলো মেয়েকে দেবী বলে ডাকবার।কিন্তু নামটা টিকলোনা। কারণ দাদুমা বলেছিলেন যে মেয়ের নাম দেবী রাখলে সত্যিকারের দেবী অখুশী হতে পারেন। অমঙ্গলের ব্যাপার।

তবু বাবা মাঝেমাঝে অরুকে দেবী ডেকে ফেলতেন। বহুদিন অনুশীলন করে ধীরে ধীরে অভ্যাস করেছিলেন। মাঝেমাঝে খুব ডাকতে ইচ্ছে করলে অপেক্ষা করে থাকতেন কখন দাদুমা হাঁটতে বেরোয়। বেরোলেই বড় মিষ্টি স্বরে ডাকতেন-দেবী!দেবীরে…কই মা?

ছোটবেলা থেকে অনেক দেবীকে ডেকেছেন বাবা। কোনদিন কেউ সাড়া দেয়নি। কিন্তু নিজের মেয়ে দেবীকে ডাকতেই সাড়া পাওয়া যেতো। ঝুটি দুলাতে দুলাতে আসতো অরু-আজ্ঞে বাবা।

অরু চলে আসলে পরে বাবা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যেতেন। তিনি তো ডাকবেন বলেই ডেকেছিলেন-ডেকে কি বলবেন-সেটা তো ভাবেননি। তিনি আমতা আমতা করে বলতেন-স্নান করেছিস?

করেছি।

কই করেছিস?তুই তো স্নান করিসনি?

করেছি তো-এই দেখো মাথা ভেজা।

মাথা জল দিয়ে ভিজিয়ে আনলেই বুঝি স্নান করা হয়! মাথার সামনে ভেজা-পিছনে ভেজেনি কেনো? যাও-এক্ষণ গামছা নিয়ে এই বাথরুমে স্নানে যাও।কোন কিন্তু নাই।

অরু মুখ গোজ করে গামছা কাঁধে বাথরুমে ঢোকে। পিছন থেকে অরুকে দেখে বাবা মুগ্ধ হয়ে যান। সারাবাড়ি জুড়ে এতো সোনা মোর-ছড়াইয়া গেছে কারা!

জোর করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর থেকে বাবা আর কখনো অরুকে দেবী বলে ডাকেননি।

আজ ডাকছেন। অরুর ঘরের দরজা পেরিয়ে খাটের কাছে হাটু গেড়ে বসে বাবা অরুকে ডাকছেন-দেবী,ও দেবী…মা রে…দেবীরে…

অরু কুঁকড়ে শুয়েছিলো। আজকাল মানুষের পায়ের আওয়াজও ভয় লাগে তার। বাবার পায়ের শব্দে লুকিয়ে কুকড়ে গিয়েছিল আরো। বাবার পায়ের আওয়াজ সে চেনে ভালমতো।

তবু দেবী ডাক শুনে সে আর লুকিয়ে থাকতে পারলোনা। ছোটবেলার অভ্যাসে বলে ফেললো-আজ্ঞে বাবা।

মা,তোর মনে আছে,ছোটবেলায় একবার তোর টনসিল অপারেশন হলো?

হুঁ

তোকে যখন অপারেশন করার জন্য নিয়ে যাচ্ছিলো তখন তুই আমাকে কি বলেছিলি মনে আছে?

আমাকে নিয়ে যাচ্ছে বাবা-আমি যাবো না…

হ্যাঁ। তখন আমি ডাক্তারদের আটকে দিলাম। বললাম আমার মেয়ের টনসিল অপারেশনের দরকার নেই।তোকে অপারেশন টেবিল থেকে তুলে নিয়ে আসলাম। মনে আছে তোর?

হুঁ

তোর ভয় হলে আমাকে বলবি না মা? তোর ভয় হতে দেই আমি? ভয় হলে বাবাকে বলতে হয় না-পাগলী? শ্বশুরবাড়ি যেতে না চাইলে যাবিনা। আমি তোকে পাঠাবোনা।তুই বাবার মেয়ে-বাবার কাছে থাকবি। ঠিক আছে?

অনেকক্ষণ কিছু শোনা যায়না। এরপর হালকা ফোঁপানি শোনা যায়। তারপর তীক্ষ্ণ কান্না। বাবা মেঝেতে শুয়ে পড়ে। এরপর বিছানার তলা থেকে অরুকে টেনে এনে বুকে চেপে ধরে। বাবার বুক জড়িয়ে ধরে কি জান্তব সুখে অরু হুটোপুটি খায় আর চিৎকার করে কাঁদে। বাবার বুক ভিজে যায়।

আমার ভালো মা-আমার লক্ষ্মী মা!

রায়বাড়িতে আনন্দের ধুম পড়ে যায়। অনেকদিনের ভোতা দুখের মাঝে এইটুকুই অনেক বেশি। অরু খাটের নিচের থেকে বের হয়েছে। অনেক বেশি।

মা আদুল গায়ের অরুকে ডলে ডলে স্নান করিয়ে দেন-ঠিক যেন তার বয়েস বারো। বাবা হাসিমুখে বাজার করতে যান। নিরু রান্নাঘরে যায়-আজ সে টেংরা রান্না করবে। অনেকদিন বাসায় কেউ আরাম করে খেতে পায়না।

অরু কিছুই খেতে চায়না। শুধু হাসিমুখে সবার দিকে চেয়ে থাকে। সবার সুখে সেও বড় সুখী। তার ভালো লাগছে। এখন আর ভয় লাগছে না। বাবা বলেছে ভয় হলে বাবা সব ঠিক করে দেবে। আর ভয় নেই।

অনেক চেষ্টাচরিত্র করে একসময় বাবা অরুকে একটু কোল্ড ড্রিংক খেতে রাজি করান। কোল্ড ড্রিংক দেয়ার আগে তাতে মিশিয়ে দেয়া হয় ডাক্তার আংকেলের দেয়া অষুধ।অষুধ খেয়ে দীর্ঘদিন পরে অরু নেতিয়ে পড়ে। আরাম করে ঘুমিয়ে পড়ে অরু। দুঃস্বপ্নহীন-যন্ত্রণাহীন নিকষ কালো ঘুম। ঘুমের মাঝে অরুর ঠোঁটে একটু হাসিও হয়তো দেখা যায়।

অরু ঘুমিয়ে পড়তেই অরুর মা ডাক্তার আংকেলকে ফোন করেন।

-জ্বী,আপনার কথামতো অষুধ খাইয়ে দিয়েছি।

-নিজের ইচ্ছায় খেয়েছে-নাকি জোর করেছেন?

-না,না। জোর করতে হয়নি। অরুর বাবার কথায় রাজি হয়ে শান্তভাবে খেয়েছে।

-অরুর বাবা আবার অরুকে রাগিয়ে দেবার মতন কিছু বলেননি তো?

-না,না।আপনি ভয় পাবেননা। নিরু যা যা শিখিয়ে দিয়েছিলো-তাই বলেছে।

-যাক-তাহলেই ভালো।কিন্তু মাথায় রাখবেন-কেউ কোনভাবেই ওকে রাগিয়ে দেবার মতন বা কষ্ট দেবার মতন করে কিছু বলবেন না। একটু হিসেব করে চলবেন। যদি তেমন কিছু না হয়-তাহলে অষুধ খেয়েই রোগ সেরে যাবে।এখন কি করছে অরু?ঘুমাচ্ছে?

-হ্যা,ঘুমাচ্ছে।

– ঘুমাক,ঘুমালেই ভালো। জেগে থাকলেই সমস্যা। ঘুমেই থাক অরু।

 

 

 

তবে একসময় অরুর ঘুম ভাঙ্গে। জেগে ওঠে অরু। জেগে উঠে শূণ্য দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকায়। বুঝতে পারেনা সে কোথায়-কেন? মা এগিয়ে আসে-‘কিরে মা?কেমন লাগছে শরীরটা এখন?’

অরু কিছু বলেনা-মাথা হেলিয়ে উত্তর দেয়। শরীর ভালো লাগছে।

মাথাব্যথা করছে? তেল দিয়ে দেবো?

অরু আবার মাথা হেলিয়ে দেয় ডানে। তেল দিয়ে দিক মা।

মা একটা স্টিলের বাটিতে নারিকেল তেল ঢেলে নেয়। অরুকে মেঝেতে বসিয়ে মা দুই পা ছড়িয়ে খাটের ওপরে বসে। একটুখানি তেল হাতে নিয়ে ঘষে নেয়। এরপর অরুর লম্বা চুলে মেখে দেয়। চুল ভর্তি জট। চুলে তে মাখতে গিয়ে টান লেগে জট ছিড়ে যাচ্ছে।খুব ব্যাথা!

কিন্তু অরুর ভ্রূক্ষেপ নেই। সে শূণ্য দৃষ্টিতে আয়নার দিকে চেয়ে আছে। চেয়ে সে কাকে দেখছে-সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা। হয় নিজেকে-নয় মা কে-নয় সবকিছুকে। সারা দুনিয়াকে সে এক অদ্ভুত শূণ্য দৃষ্টি দিয়ে ঘিরে রেখেছে।

মাথায় তেল ডলতে ডলতে মায়ের মুখ থেকে মৃদু স্বরে জ্ঞানের বাণী বের হয়। এই জ্ঞানের বাণী মা শিখেছে তার মামার বাড়িতে। মা বাবামায়ের মেজোসন্তান। সহজ করে বলতে হয় মেজো ‘মেয়ে’। অনেক মন্দিরে মানত রাখার পর শিবরাম বসাকের চতুর্থ সন্তান হয় ছেলে। কাজেই বাকি তিন তিনটি মেয়ের ভার বহন তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে।

তিন মেয়ের মধ্যে প্রথমটি বড় আদরণীয়া।প্রথম সন্তান বলে কথা! তৃতীয়টি দুরন্ত। বাপের বাড়ি ছেড়ে মামার বাড়ি যাবার কথা বললে শিবরাম বসাককে সে কামড়ে দেবার সম্ভাবনা আছে। তাই মদ্যিখানের নম্র-ভদ্র-সভ্য মেয়েটাকেই তার মামারবাড়ি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হলো।

তাকে বোঝানো হলো-ভালো শিক্ষার জন্যে শহরে পাঠানো হচ্ছে। বাপ-মা তাকে কম ভালোবাসেনা। কিন্তু মামা-মামীরা আরো বেশি ভালোবাসে।

মামা-মামীর বাপ-মাকে টক্কর দিতে খুব একটা কষ্ট করতে হতোনা-কিন্তু তারা সেটুকু করতেও অরাজি ছিলেন। মধ্যের মেয়েটিকে তাই ছোটবেলা থেকেই গলগণ্ডের মতন অপরের বোঝা হয়ে থাকা শিখতে হয়েছে। কাজেই গিন্নিবিদ্যার সে বড় সুনিপুণ। কেমন করে অপরের আগ্রাসনের তলে মাথা নিচু করে থাকতে হয়-তার চেয়ে ভালো কেউ জানেনা। তাই মেয়ের মাথায় তেল দিতে দিতে তার কন্ঠে সেইসব জ্ঞানের অমৃতকথা ঝরে পড়ে।

মামনি-তুই যদি তোর শ্বশুরমশায়ের কথায় রাগ করে থাকিস-তাহলে তুই ভুল করছিস। নতুন বিয়ের পরপর ওরকম শ্বশুরবাড়ি নিয়ে সবার একটু কষ্ট হয়। তুই যখন আমার পেটে-তখনও তোর দাদুমা আমাকে দিয়ে বাসন মাজাতো। ব্যাথায় কাজ করতে না পারলে বলতো আমি কামচোর। তাই ব্যাথা হলে জানলার গ্রীল চেপে ধরে ব্যাথা লুকাতাম। তাই করতে গিয়ে একবার গ্রীলের চাপে হাতের মাংস থেঁতলে গেলো।

তবু কি আমি সব ছেড়েছুড়ে চলে গেছিলাম? যাইনি! তখন যদি আমি সব সহ্য না করে তোর মতন এমন সংসারে ইস্তফা দিয়ে চলে আসতাম-তাহলে কি তোরা আজকে এতো ভালো একটা ঘরে থাকতে পারতি? পারতি না! কাজেই সংসারের জন্যে মাঝেমাঝে একটু আপোষ করতে জানতে হয়। বুঝলি?

অরু বুঝতে পারছে কিনা বোঝা যায়না। সে চুপচাপ শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে একদিকে। শুধু পার্থক্য হলো-এখন তার চোখটা ভেজা।

এভাবে দিন কাটে। অরুকে বেশিক্ষণ জেগে থাকতে দেয়া হয়না। কে জানে-কখন কিসে আবার পাগলামি বেড়ে যায়। অরু জেগে থাকে বড়জোর দুই কি তিন ঘন্টা। এই দুই তিনঘন্টা সে আতিপাতি করে তার ফেমিনিজমের পোস্টারটা খোঁজে। কিন্তু খুঁজে পায়না। কারণ সেইদিনের পর তাকে অন্যঘরে নিয়ে আসা হয়েছে। তাকে এই ঘর থেকে বের হতে দেয়া হচ্ছেনা।

ডাক্তার বলছে অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। এখন আর কোন পাগলামির লক্ষণ নেই। চুপচাপ হয়ে গেছে খুব। সেটা খুবই ভালো লক্ষণ। এভাবে একটা অষুধ আর দুই সপ্তাহ আর একটা অষুধ টানা এক বছর চালিয়ে গেলে অনেকটা সেরে আসবে।

কিন্তু ডাক্তারসাহেব, দেবব্রত ফোন করেছিলো। সে নাকি তার বাসায় ম্যানেজ করেছে যাতে অরুকে ফিরিয়ে নেয়। সে ওদের বুঝিয়েছে যে অরু এখন সুস্থ। তারা অরুকে দেখতে আসতে চাইছে। দেখতে চাইছে অরুর পাগলামি সুস্থ হয়েছে কিনা। তাদের সাথে দেখা করার মতন অবস্থায় কি এখন অরু পৌঁছেছে?

এখনো নয়। তাদেরকে বলুন আরো সপ্তাদুয়েক পরে আসতে।ততদিনে আরো স্বাভাবিক হয়ে আসবে। অরু কোথায়-ওকে দেখতাম একটু।

ঘুমাচ্ছে। আজকাল সারাদিন ঘুমায়।

ঘুমাক,ঘুমালেই ভালো। জেগে থাকলেই সমস্যা। ঘুমেই থাক অরু।

 

 

আজ সকালের ফ্লাইটে মিসেস অরুণিমা চক্রবর্তী লন্ডন চলে গেছে।

এয়ারপোর্টে এসেছিলো অরুর শ্বশুরবাড়ির সব লোকজন। সি-অফের সময় তাদের প্রণাম করতে করতে অরুর কোমর ব্যাথা হয়ে গেলো।

অরুদের বাসা থেকে খালি অরুর বাবা আর মা-নিরু আসেনি।

লন্ডনে গিয়ে ফোন করেছিলো অরু-তার সাথে দেখা হয়েছে দেবব্রতের। দেবব্রতের সাথে কথা বলে বাবা মা নিশ্চিত হয়েছে যে অরু ভালো আছে-সুস্থ আছে। তারপর অনেকক্ষণ ধরে দেবব্রতকে এক এক করে অরুর সবগুলো অষুধ খাবার সময়সূচি বুঝিয়ে বুঝিয়ে বলে দিয়েছেন বাবা।

নিরুর আজ মন দারুণ খারাপ।

কাল নিরুকে দেখতে আসবে একদল মানুষ। তাদের একজন নিরুকে বিয়ে করতে চায়। তাকে নিরু চেনে না এবং সেও নিরুকে চেনে না। তবু সে যদি নিরুকে বিয়ে করার বায়না করে-নিরুর তাকেই বিয়ে করতে হবে।

বাবা মায়ের মুখের ওপর না বলার সাহস নেই নিরুর।

কখনো বাবা মায়ের একটুকু সুখের কারণ হতে পারেনি নিরু-সেই সামর্থ্য তার ছিলোনা। তাই তাদের সামান্যতম দুঃখের কারণ হবার অধিকার নেই তার।

দিদি পারেনি-সে পারবে কেমন করে? দুইজনের মধ্যে দিদিই ছিলো বেশি সাহসী।

সেই ছোটবেলার থেকে দস্যি ছিলো দিদি। যা চাইতো-করতো। আর নিরু তার সব কাজের নিরব সহযোগী। কি করছে-কেন করছে-অনেক সময় সেটাও জিজ্ঞেস করতোনা নিরু। দিদি যা করছে-ঠিক করছে। দিদিকে অনুসরণ করার মাঝে একটা অন্ধ নিশ্চয়তা আছে নিরুর। দিদির পিছনে পিছনে হেঁটে এসেছে সে সারাটা জীবন। পরম আনন্দে-পরম নির্ভরতায়।

কিন্তু এখন কি করবে নিরু? কোথায় যাবে সে? দিদির পায়ের ছাপ এসে যেখানে ঠেকেছে সেখান থেকে উলটো ঘুরে এমন অন্ধকারে গিয়ে মিলেছে যে দিদির ছিবড়েও আর নেই কোথাও। নিরুরও কি তাই করার কথা? নিরুরও কি দিদির পিছন পিছন যাবার কথা?নিরুরও কি ছিবড়ে হয়ে যাবার কথা?

হঠাৎ মনে হয় সব ছেড়ে পালিয়ে যাবে নিরু।

সাহস হয়না। দুইজনের মধ্যে কখনই সে সাহসী জন ছিলোনা। সে ছিলো ভীতু-দিদি তার সাহস।

এতো চিন্তা করার কথা তো ছিলোনা নিরুর। তার শুধু দিদির পিছনে হাটার কথা ছিলো। দিদির কথা শুনে চলার কথা ছিলো। দিদি কোথায়?

নিরু হেঁটে দিদির ঘরে ঢুকে দাঁড়ায়। ঘরটা এখন ফাঁকা। এক পাশে অবহেলায় পড়ে আছে বিছানা।চাদর বদলানো হয়নি বহুদিন। এই ঘরে এই পরিবারের কেউ ঢোকেনা। অন্ধকার দিনগুলির কথা অনেক কষ্টে ছিপি দিয়ে রেখেছে সকলে-এই ঘরে ঢুকলেই যেন তার সবটা গলগলিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

নিরু তবু এখানেই ফিরে এসেছে। কারণ তার স্মৃতিতে সে কখনো ছিপি লাগাতে পারেনি। বরং এই ঘরের বন্ধ গুমোটে যেন তার একটু শান্তি লাগে।

কিন্তু আজ লাগছেনা-আজ কেমন অসহায় আর দিশেহারা লাগছে। সব কি মিথ্যা ছিলো দিদি? শেষে কি সবারই হেরে যেতে হয়? শেষে কি সবাই ‘মা’ হয়ে যায়?

তুমি আর আমি না কতো হাসাহাসি করতাম মা কে নিয়ে?

সেই আমরাও কি শেষে ‘মা’ হয়ে যাবো?

প্রচন্ড রাগে আর ক্ষোভে নিরু ঘরের মাঝে দাপাদাপি করতে থাকে। অদ্ভুত ক্রোধ ঢেলে দেবার জন্য তার নিরপরাধ কাউকে দরকার। নিরপরাধকে শাস্তি দিলেই কেবল এই রাগ কমতে পারে।

তখনই নিরুর চোখে পড়লো সেই হলদে ফেমিনিজমের পোস্টারটা। সব নষ্টের গোড়া। শুরুতে এইসব না থাকলে-শেষে এতো কষ্ট হতো না।বজ্জার হলুদ পোস্টার!

পাগলের মতন পোস্টারটার উপর ঝাপিয়ে পড়ে নিরু। সে ছিড়ে ফেলবে-কুটিকুটি করে ফেলবে সবটা।

তখনই যেন কে ডাকলো তাকে-নিরু!এই নিরু।

গলাটা ঠিক যেন অরুদির মতন। কোথা থেকে আসছে?নিরু কি ভুল শুনলো?

না-ভুল মোটেই নয়। খাটের নিচের থেকে নিরুকে ডাকছে কেউ।

কুঁজো হয়ে বসে খাটের নিচে তাকালো নিরু।

কুকুরকুন্ডলী হয়ে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে অরু।

তুমি! তুমি! তুমি এখানে কেমন করে? তুমি না চলে গেলে? তুমি এখানে কেমন করে?

আমি আবার কোথায় গেলাম রে? আমি তো কোথাও যাইনি! আমি তো এখানেই ছিলাম। ওই যেদিন ওরা আমাকে তাড়িয়ে এখানে লুকিয়ে দিলো-তখন থেকে আমি এখানেই আছি-বের হইনিতো কখনো!লুকোচুরি খেলার মতন লুকিয়ে আছি।কেউ খুঁজে পাচ্ছেনা।

দিদি…ওরা আমাকে নিয়ে যাবে দিদি…ওরা নিয়ে যাবে…আমি যাবো না…

যাস না। এখানে আয়।আমার সাথে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাক। আমি তোকে লুকিয়ে দেবো। আমার কাছে কোন ভয় নেই। সব ভয় দূর করে দেবো আমি। এখানে আয়-মা!আর কেউ তোকে খুঁজে পাবেনা।

অরুর স্বর অনুসরণ করে নিরু খাটের নিচে ঢুকে পড়ে-পরম নির্ভরতায়-পরম বিশ্বাসে।

তারপর চার হাত পা দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে অরুকে।

ওদের আর কেউ কখনো খুঁজে পাবে না।

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.