কুহক

ভাইজান,কোরআন শরীফ এনে দিবো?
জি?
পিচিক করে পানের পিক ফেলে গার্ড শ্লেষ্মাজড়িত কন্ঠে বললো,কোরআন শরীফ এনে দিবো ভাইজান?মৃত্যুর আগমুহুর্ত পর্যন্ত কোরআন শরীফ পড়তে থাকেন।খুন করসেন তো কি হইসে?আল্লাহর কাসে তাওবা কইরা মাফ চান।নিশ্চয়ই তিনি মাফ করে দিবেন। ।ফাঁসি হবার সাথে সাথে ডাইরেক্ট জান্নাত!
নলিনী বাবু ঘোর লাগা গলায় বললেন,ভাই,আমি খুন করিনাই।
গার্ড লালরঙ্গা বত্রিশটা দাত বের করে বললো,অবশ্যি খুন করেননাই ভাইজান।নিশ্চয়ই হারামজাদা উকিলেই ঝামেলা কইরা দিসে।তাইনা?আরে ভাই,আমরা হইলাম এক্সপেরিয়েন্সড মানুষ।দশ বছর ধইরা ডিউটি করতাসি।সবের একই কথা।হারামজাদা উকিল!এই জন্যেই তো কথায় কয়,দশটা শকুন মরলে একটা উকিল জন্মায়।
গার্ড তালুর উপর ভর করে বসে পড়ে।মুখ নিয়ে আসে শিকের কাছাকাছি।দূর্গন্ধে পেট উলটে আসতে চায় নলিনী বাবুর।
ভাইজান কখনো মানুষ মারেননাই বুঝলাম!মশাটশা তো মারছেন।মশার পরিবারেরে দুখ দিসেন।মরার আগে তাই পাক কালাম ছুই তার জন্য মাফ চান।আল্লাহ গাফুরুর রহিম!নিশ্চয়ই তিনি মাফ করবেন!
ভাই,আমি হিন্দু।
হিন্দু হইসে তো কি হইসে?ফাঁসির হিন্দু মুসলমান নাই।হিন্দু হইলেও আপনারে দড়িত লটকি দিবো,মুসলমান হইলেও দড়ীত লটকি দিবো।এমন তো না যে হিন্দু বইলা জামাই আদর দিয়া আপনারে ইন্ডিয়ার ট্রেনে তুইলা দিবো।আল্লাহপাক গাফুরুর রহিম!শেষ ওয়াক্তে ঈমান আনেন,তার দয়া হবে।মরণমাত্র সিধা জান্নাত।এইখানে টানবো ফাঁসির রশি,ওইখানে খুলবো জান্নাতের দরোজা।
ভাই,আমি স্বমেহন করেছি।গা গরম তরলে মাখামাখি হয়ে নাপাক হয়ে আছে।এরকম অবস্থায় কি পাক কালাম স্পর্শ করা উচিত?
গার্ড লাফ দিয়ে সরে গেলো। সম্ভবত শারিরীক সম্পর্ক সংক্রান্ত একটা গালিও দিলো।
নলিনীবাবু বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করলেন না।গভীর মনোযোগে নখ দিয়ে খুটরে খুটরে দেয়ালে নিজের নাম লিখতে থাকেন।হাতের লেখা ভালো হচ্ছে না।ব্যাপারটা নলিনী বাবুর পছন্দ হচ্ছে না।কি কষ্ট করেই না তিনি হাতের লেখাটা সুন্দর করেছিলেন!এখন আবার সব গুবলেট হয়ে যাচ্ছে!
প্রতিদিন অতি ভোরবেলা উঠে পিতা বাংলা শিক্ষক হরিমোহন দাস তাকে নিয়ে হাতের লেখা প্র্যাকটিস করতে বসাতেন।নলিনী বাবু পিতাকে খুবই ভয় পেতেন।তার কাছে মনে হত তার সামনে জলজ্যান্ত কোন মামদো ভূত বসে আছে।কাজেই হাতের লেখার মাঝেও ভীতভাব চলে আসতো।পাড়াপড়শির ঘুম ভাঙ্গতো হরিমোহন দাশের থাপ্পড়নিনাদে।
এত চেষ্টাতেও যখন কিছু ফল হলো না তখন হরিমোহন দাশ ঠিক করলেন তার অপদার্থ পুত্রের পনেরতম জন্মদিনে সবচেয়ে দামি কলমটা কিনে দেবেন।কলমের দাম শুনে লজ্জায় পড়ে যদি ছেলের লেখাটার কিছু গতি হয়।
বাংলাদেশের নদীতে নৌচলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় নাব্যতা নেই,কিন্তু বাস ডুবে যাবার মতো নাব্যতা ঠিকই আছে।কাজেই ঢাকা থেকে ফেরার পথে জনৈক শ্যামা পরিবহনের বাসের সাথেসাথে জনৈক হরিমোহন দাশ পঞ্চাশ টাকা দামের পার্কার কলম পকেটে নিয়ে টুপ করে জনৈক নদীতে ডুবে গেলেন।
এ দূর্ঘটনায় চেয়ারম্যানের হৃদয়বিদারিত হলো।তিনি হরিমোহন দাশের স্ত্রী লক্ষীরানী দেবীকে একটি ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল ক্ষতিপূরণ দিলেন।কিশোর নলিনী পিতার বিনিময়ে ছাগল পেয়ে বিস্ময়ে অভিভূত হলো।এই অভিভূত অবস্থা কাটতে না কাটতেই একটি ঘুর্নিঝড়ে নলিনীবাবুর ঘর এবং মমতাময়ী মাতা উড়ে চলে গেলো।প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী চেয়ারম্যান সাহেব নলিনীকান্ত দাশের হাতে ত্রাণসামগ্রী ও একটি ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল তুলে দিলেন।পিতা এবং মাতার বিনিময়ে পাওয়া দুইটি ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল নিয়ে নলিনী বাবু তার মামার বাড়িতে উঠে এলেন।মামা মেট্রিক পর্যন্ত ভরণপোষন করে দুই ছাগল এবং পৈতৃক জমিজিরাত নিজের কাছে রেখে দিয়ে তাকে স্বনির্ভর হয়ে বেচে থাকার শিক্ষা দিতে ঘর থেকে বের করে দিলেন।
মেট্রিক পরীক্ষায় নলিনী বাবু স্টার মার্কস পেলেন।তার ছাগল হারানোর শোক কিছুটা ঘুচলো।এবার তিনি আশ্রয় পেলেন তার স্কুলের হেডমাস্টারের বাড়িতে।
ভাই,এই নেন,পানি।
জি?
পানি নেন ভাই,পাকসাফ হন।আপনি নাপাক অবস্থায় বসে আছেন,এটা সহ্য হচ্ছে না।তাছাড়া গন্ধ ও আসতেসে।ধুয়ে ফেলেন তাড়াতাড়ি।
নলিনী বাবু পাকসাফ হলেন।
ভাই,একটা বিড়ি হবে?
বিড়ি তোমার ওইখান দিয়ে ঢুকায়ে দেবো হারামজাদা।
একটু পরে তো মরেই যাবো,তখন যা ইচ্ছা কইরেন।আপাতত একটা বিড়ি থাকলে দেন।
গার্ডসাহেব এবার কিছুটা নরম হলেন।একটা বিড়ি আর দেশলাই ছুড়ে দিলেন শিকের ফাক দিয়ে।
মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে।আজকাল বিড়ির মাঝে গাঁজাটাজা দেয় বোধহয়।আগে গাঁজা ছিলো নিষিদ্ধ বস্তু।এখন গাঁজা হয়েছে আধুনিকতার অনুষঙ্গ।র‍্যাপ গান বা ধর্ষিত সঙ্গীত রচিত হয়েছেঃ
আমি বাঙ্গলায় হিপহপ গাই
মাঞ্জা মাইরা গাঞ্জা খাই।
নিষিদ্ধ কাজ করার মজা আলাদা।কাজেই আলাদা কিছুটা মজা পাবার আশাতেই সম্ভবত নলিনীবাবু হেডস্যারের বাংলা ঘরে একলা ভোররাতে গাঁজা খেতেন মাঝেমাঝে।প্রথমে কম করে।পরে বাড়তে থাকে।একাকিত্ব আর গাঁজা হয়ে ওঠে তার নিকটতম বন্ধু।
রাতে ঘুম হত না।ভোররাতে ছোট্ট বাগানটিতে পায়চারি করতে করতে গাঁজা টানা একসময় রুটিন হয়ে ওঠে।নোনতা চোখ,বকেয়া ঘুম আর গাজা,এই তিনে মিলে এক চমৎকার রহস্য সৃষ্টি করতো।এই রহস্য উপভোগ করতে করতেই জীবনের সবচেয়ে বড় রহস্যের দেখা পান তিনি।
মেয়েটার দেহটা ছিপছিপে।কৈশোর খেলা করে যাচ্ছে সারা মুখে।ঠিক নলিনীবাবুর সমান বয়সী।ধারালো চেহারা।কিন্তু চোখদুটো বড্ড মায়াবী।নলিনীবাবুর মায়ের মত।
মেয়েটা কোন অধিকারে কে জানে?বিড়ি ফুকতে দেখলেই চোখ পাকিয়ে তাকাতো তার দিকে।
ছেলেটিই বা কোন সম্পর্কের টানে কে জানে?তাকে দেখেমাত্র বিড়িটা ফেলে দিয়ে অপরাধি চোখে মাথা চুলকাতে শুরু করতো।
মগটা বের করে নিতে গরাদের ভেতর হাতটা ঢুকায় গার্ড।খপ করে হাতটা ধরে ফেলেন নলিনীবাবু।গার্ডের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যায় ভয়ে।হোকনা গরাদের পিছনে,তবুও খুনি তো!
ভাই সাহেব,এক পুরিয়া গাঁজা জোগাড় করে দিতে পারবেন?জীবনে শেষবারের মতো নেশা করি।
এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিয়ে গার্ড টানা অনেকগুলো অশ্লীল গালি দিয়ে গেলো।নলিনী বাবু গালিগুলো শুনে যতটা না অপমানিত হলেন,তারচে বরং বাংলা ভাষার অশ্লীল গালিভান্ডার দেখে মুগ্ধ হলেন বেশি।
নলিনীবাবু বিয়ে করেন ঊনিশশো একাশি সালেই বাইশে চৈত্র।
সেইদিন আইএ পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছিলো।সেকেন্ড ডিভিশন পেয়েছিলেন তিনি।বুকটা ভেঙ্গে গিয়েছিলো তার।
প্রচন্ড মানসিক যন্ত্রণা থেকে পালানোর আশায় ধারালো চেহারার সেই কুহক নামের মেয়েটার ভয়ে সযতনে লুকিয়ে রাখা গাঁজার পুরিয়া বের করে ধরালেন তিনি।
কয়েকটা টান দিতেই কুহু কোত্থেকে যেনো এসে কোমরে হাত দিয়ে চোখ পাকিয়ে দাঁড়ালো।হুড়োহুড়ি করে বিড়িটা লুকান নলিনিবাবু।
এটা কি হচ্ছে?
মনটা বড় খারাপ রে কুহু।
মন খারাপ হলে আমাকে ডাকতি।আমার চেয়ে তোর গাঁজা আপন হলো।
তুই ছাড়া আমার কে আছে বল?কিন্তু গাঁজা খেলে একটূ নেশা হয় তো,দুঃখ ঢুকতে পারে না মাথার ভেতর।
ও গাঁজা নেশা ধরায় বলে আমার চেয়ে গাঁজা বেশি প্রিয় হয়ে গেলো?আয় হারামজাদা!তোকে নেশা দেখাই।
সেদিন খুব কম বয়সেই নলিনীবাবু দুইটি জিনিস হারালেন
কুমারত্ব এবং হৃদয়।
দুজনে মিলে পালিয়ে এলেন একটা দূরের শহরে।কয়েকটা টিউশন জোগাড় হলো। সৃষ্টি হলো ছোট্ট সুখের সংসার।
সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে অথবা স্ত্রৈণ পুরুষের গুনে।নলিনী বাবু বিপুল বিক্রমে স্ত্রৈণ পুরুষের ভুমিকা গ্রহণ করলেন।দিনরাত কাজ করতেন আর মাঝে মাঝে এসে এসে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে কুহুর সাজগোজ অথবা তেতুলের চাটনি খাওয়া দেখে যেতেন।আর বিড়বিড় করে বলতেন,আমি এতো সুখি কেনো?
নলিনি বাবুর সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রীর নাম সুমাইয়া।মেয়েটা ছাত্রী খুব ভালো।দেখতেও খুব সুন্দর।ঢঙ্গীও না। এরকম কম্বিনেশন সাধারণত পাওয়া যায় না।ছাত্রী ভালো হলে সুন্দর হয় না।সুন্দর হলেই ঢঙ্গী হয়,এই ধরণের অবস্থা।কিন্তু এই মেয়ে এই ইউনিভার্সাল বেকায়দার ভিতরেও কিভাবে যেন কায়দা করে একইসাথে ত্রিগুণসম্পন্না হয়ে গেছে।তার সাথে নলিনীবাবুর সম্পর্কও খুব চমৎকার।নলিনীবাবুর কখনো কোন বন্ধু ছিলোনা।তাই ছাত্রী হয়েও সুমাইয়া হয়ে উঠেছে তার বন্ধুর মতই।
জানো সুমাইয়া,আজকে নদীর ধারে ঘুরতে গিয়েছিলাম।
তাই নাকি?কখন গেলেন?
এইতো দুপুরবেলা।ফেরার পথে রাস্তার ধারে একটা হাসনাহেনা ফুলের গাছ পেলাম। সাথেসাথে একটা জিনিস টের পেলাম।
কি?
তুমি গায়ে যে পারফিউমটা দাও সেটার গন্ধ হাসনাহেনার মত।ঠিক হয়েছে?
সুমাইয়া লজ্জায় পড়ে যায়।সে কখনও কোন পারফিউম ব্যবহার করে না।তবুও স্যার তার গায়ের থেকে হাসনাহেনার গন্ধ কিভাবে পেলেন কে জানে?
বাসার পিছনে এনে পুতেছি হাসনাহেনা গাছটা।নাম দিয়েছি কস্তুরি।ওটা আমার মেয়ে!
হাসনাহেনা গাছ আপনার মেয়ে!স্যার,আপনি দেখি আধাপাগলা মানুষ।গাছকে কেউ মেয়ে বানিয়ে নামধাম দেয় নাকি?
আমি দেই।যাতে মানুষজন মনে করে আমি আধাপাগল।পুরোপুরিই যে পাগল সেটা যেনো টের না পায়।
হাসতে গড়িয়ে পড়ে সুমাইয়া।হাসির দমকে দমকে তিরতির করে কেঁপে ওঠে তার গালের পাতলা চামড়া।
এক কাজ করেন স্যার,আমাকে বিয়ে করে ফেলেন!তাহলে আর গাছকে মেয়ে বানাতে হবে না।সত্যিসত্যি ছেলেমেয়ে জন্ম দিতে পারবেন।
নলিনি বাবুর বুকটা ধড়াশ করে ওঠে।মুখটা রক্তশূন্য হয়ে যায়।
সুমাইয়া হো হো করে হেসে ওঠে।
দিনদিন সুমাইয়ার হাসি কেমন যেনো কুহুর মতো হয়ে যাচ্ছে।হাসার সময় কুহুর যেমন গালের চামড়া কাঁপে,সুমাইয়ারও তেমন করেই কাঁপে।কুহুর গায়ের রঙও কেমন যেনো খোলতাই হয়ে টুকটুকে হয়ে গেছে।আগে ঠিকমতো পড়তেও পারতো না,সেদিন ঘরে ফিরে নলিনি বাবু দেখলেন আধশোয়া হয়ে কৃষ্ণকান্তের উইল পড়ছে সে।
যাহ!কিসব যা তা ভাবছেন তিনি।কোথায় তার এতদিনের স্ত্রী কুহু আর কোথায় সামান্য ছাত্রী সুমাইয়া।নিজের ওপর নিজের প্রচন্ড রাগ হতে থাকে তার।ইচ্ছা করে নিজের মাথা নিজে ভেঙ্গে ফেলতে।
নলিনী বাবুর যখন যেরকম লাগে,কুহুরও ঠিক একই রকম লাগে।এতটুকু এদিক সেদিক নেই।হয়তো নলিনীবাবু প্রচন্ড গরমে হাঁসফাঁস করছেন,বিচ্ছিরি গরম বলে কুহু উঠে গিয়ে ফ্যানটা ছেড়ে দেবে।মন খারাপ,দেখা যাবে কুহুও মুখ ভার করে বসে আছে এক চিলতে বারান্দাটায়।খুব ভালো কিছু ঘটলো,মনটা খুব ভালো,ঘরে ফিরতেই দেখবেন কুহু সেজেগুজে পায়ে আলতা দিয়ে,নূপূর পরে খাটে বসে মিটিমিটি হাসছে।
জিনিসটাকে খুব রোমান্টিক বলে মনে হয় নলিনীবাবুর।
এই মিষ্টি ভালোবাসার টানেই কিনা কে জানে,নিজের উপর নিজের রাগ যেতে না যেতেই কুহু তার উপর তারস্বরে চিৎকার শুরু করে।
বা!বা!বা! বাবুসাহেব এলেন তাহলে?কেনো এলে?ওখানেই থেকে যেতে।থেকে থেকে সুমাইয়ার গায়ের থেকে ফুলের গন্ধ নিতে।একঘেয়ে বউয়ের কাছে ফিরে এসেছো কেন?
কি বলছো এসব কুহু?
ঠিকই বলছি।এক ঘন্টার টিউশনিতে তিনঘন্টা কাটায়ে আসো।বাকি দুই ঘন্টা কি করো? পিরীত শিখাও?নাকি ফ্যামিলি প্ল্যানিং করো?
ছি কুহু!ছি!আমাকে এতোটুকু বিশ্বাস নেই তোমার?এতোদিন সংসার করে আমাকে এতোটুকুও চেনোনি?
ভুল করেছি।তখন ছোট ছিলাম।তখন যদি টের পেতাম তুমি ঘুরে ঘুরে মেয়েদের গায়ের গন্ধ শুকে বেড়াবে তাহলে কোনদিন তোমার সামনেই আসতাম না।
হঠাৎ করে টন করে মাথায় রক্ত উঠে যায় নলিনীবাবুর।গটগট করে ঘর থেকে বের হয়ে যান তিনি।বাইরে প্রচন্ড কালবৈশাখীর ঝড়।ঝড় ঠেলে এগিয়ে যান রেলস্টেশনের দিকে।অনেকটা গাঁজা কিনে নেন।আজকে তিনি নেশা করবেন।অনেক অনেক নেশা করবেন। গাঁজা টানতে টানতে মরে পড়ে থাকবেন প্ল্যাটফর্মে।
মোবাইলটা বেজে ওঠে।কোনমতে টাল সামলে ফোনটা তুলে নেন নলিনীকান্তি দাশ।
স্যার,আমার কোন হাসনাহেনার ঘ্রাণওয়ালা পারফিউম নেই।তাও আপনি আমার গায়ের থেকে হাসনাহেনার গন্ধ পান। আপনার কোনই পারফিউম নেই।তবু জানেন,আমি আপনার গায়ের থেকে গোলাপ ফুলের ঘ্রাণ পাই।
সুমাইয়া ঝরঝর করে কেদে ফেললো।
স্যার,আমি বাসায় একা।আমাকে আটকাবার কেউ নেই।আমি রাত দুটো পর্যন্ত ছাদে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আপনার জন্য অপেক্ষা করবো।তারপর নিচে ঝাঁপ দেবো।আমার জীবন আমি আপনার হাতে রাখলাম।আপনি কি আপনার জীবনটা আমাকে দিয়ে আমার জীবনটা বাঁচাবেন?
নলিনীবাবু তড়িঘড়ি দৌড় দিলেন সুমাইয়ার বাসার দিকে।থামালেন সুমাইয়াকে।কিন্তু তারপর নিজেকে আর থামিয়ে রাখতে পারলেন না।অবৈধ সমাজের বৈধতার সব বিধিনিষেধ ভেঙ্গে চুরমার করে দিলেন।
অতঃপর সুমাইয়ার আয়তকৃষ্ণ চোখের দিকে তাকিয়ে উচ্চারণ করলেন তিনটি শব্দের পবিত্রতম বাক্যটি।
সাথে সাথে কালবৈশাখীর মত্ত ঝাপটায় হাট করে খুলে যায় দরজাটা।কুহু।চোখে তার উন্মত্ততা,পাগলিনীর মতো ফুঁসছে সে।তার হাতে একটা বিরাট ছোরা।
নলিনীবাবু ধড়মড় করে উঠে বসে ভয়ার্ত কন্ঠে চিৎকার দিয়ে উঠলেন,না,কুহু না।
সুমাইয়া রাজ্যের বিস্ময় চোখে নিয়ে মায়াভরা গলায় বলে,কার সাথে কথা বলেন?
বাক্যটা শেষ হবার আগেই মায়াভরা কন্ঠটা চিররুদ্ধ হয়ে যায়।
ফজরের আযান দিচ্ছে।
গার্ডসাহেব নলিনীকে ডেকে বললেন,নেন আপনার গাঞ্জা।শেষবার সাধ করেছেন,কেমনে ফেলি?
বিড়িটা শেষ করে বাইর হয়া আসেন,সময় হইছে।
তারপর একটু ইতস্তত করে বললেন,আপনি মানুষটা বড়ই আচানক।পড়ালিখা জানা মানুষ,বাচ্চা একটা মাইয়ারে বেহুদা খুন কইরা ফালাইলেন।আবার দিনরাত বইসা বইসা একা একা কার লগে জানি কথা কন।কার লগে এতো কথা আপনের?
গাঁজা টানতে টানতে একটা অকৃত্রিম হাসি দিয়ে নলিনীবাবু বলেন,আমার বউ কুহকের সাথে কথা বলি।কুহু,গার্ডসাহেবরে সালাম দাও।
গার্ডসাহেব ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকেন,সেলের ভেতর নলিনী বাবু ছাড়া আর কেউই নেই।
টকটকে সূর্যের পবিত্র হলুদ আলো গরাদের ফাক দিয়ে সেলে প্রবেশ করেছে।শিকে জন্য আলোটা কেটে কেটে গেছে।সেই আলোয় পা ছড়িয়ে আলতা মাখছেন নলিনীবাবুর আবাল্য কল্পিতা স্ত্রী।
হঠাৎ অকারণেই হাসতে শুরু করে সে।ভোরের কুমারী আলো এসে পড়ে তার হাসিমুখের উপর।গালের পাতলা চামড়া তিরতির করে কাঁপতে থাকে।
নোনতা চোখ,বকেয়া ঘুম আর গাঁজার নেশা মিলে চমৎকার এক রহস্য সৃষ্টি করে।
তার মনে হতে থাকে তার সামনে কুহু নয়,সুমাইয়া বসে আছে।

সমাপ্ত

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.