Watch on Facebook: https://www.facebook.com/AnupamDebashisRoy/videos/vl.783086325214145/1268393566592685/
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের মননে ও মগজে এখনও সবচেয়ে তাজা খবর হলো সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য অপসারণ আর জাজ মাল্টিমিডিয়ার নতুন মিউজিক ভিডিও ‘আল্লাহ মেহেরবান।’ যদিও আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে এই দুইটি সংবাদ সম্পূর্ণ দুইপ্রান্তের দুইটি ঘটনা, কিন্তু মনোযোগ দিয়ে শুনলে কিন্তু ভাস্কর্য অপসারণের ভিডিওর ব্যাকগ্রাউন্ডে আল্লাহ মেহেরবান গানের লিরিকস বাজতে শোনা যাবে। কেননা, জাজ মাল্টিমিডিয়া আর আওয়ামী লীগ সরকার উভয়েই খুব চমৎকার একটা মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি ব্যবহার করে তাদের নিজেদের নিজেদের সিনেমার ট্রেইলার প্রচারের কাজ শুরু করেছে, সেটা হলো ধর্মীয় বিতর্ক সৃষ্টি করে জনগণের মনোযোগ আকর্ষণ করা। জাজ মাল্টিমিডিয়া সিনেমার নাম বস ২, আর সরকারের সিনেমার নাম নির্বাচন ২০১৮।
আমি ব্যক্তিগতভাবে এই বিষয়ে খুব বেশি কথাবার্তা বলিনাই কারণ আমার কাছে মনে হয় যে যতক্ষণ পর্যন্ত আমার সাধারণ জনগণের পেটে লাথি না পড়ছে-ততক্ষণ পর্যন্ত রাজনীতিতে যতকিছু চলছে তা হল নিকট ভবিষ্যতে পেটে লাথির পরিকল্পনা ঢাকার অভিসন্ধি। এবং সত্যিসত্যিই ভাস্কর্যের তলেতলে সরকার বেশ ভালোভাবেই জনগণকে লাথি মারার ব্যবস্থা করেছে। তবে এইবারের লাথিটা পড়বে পশ্চাৎদেশে।
মহামতি অর্থমন্ত্রী মালসাহেব খেয়াল করেছেন যে বাংলাদেশের ব্যাংকিংখাতে অনেকগুলা টাকা পড়ে রয়েছে যেগুলো বিনিয়োগ হচ্ছেনা। কাজেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে এখন ব্যাংকে ১ লাখ টাকা রাখলে ৮০০ টাকা কর কেটে রাখবেন। বাহ! কি চমৎকার বুদ্ধি! যেহেতু এখন ব্যাংকে টাকা রাখলেই সরকার টাকা মেরে দেয়, তাইলে অবশ্যই মানুষ এখন সেই টাকা বিনিয়োগ করতে বাধ্য! মারাত্মক পরিকল্পনা। এই প্ল্যান এক্কেবারে অব্যর্থ-হইতো যদি কোন আমানতকারীর বাসায় তোষক না থাকতো। কিন্তু তোষক থাকার কারণে এখন যেটা হবে-সেটা হল এই ব্যাংকে থাকা টাকাগুলো উইথড্র হয়ে তোষকের মাঝে ডিপোজিট হবে।
এইযে তোষকে টাকা ভরে রাখা-এইটাই কিন্তু বরং বাংলাদেশের একটা বড়ো সমস্যা। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক চেষ্টা করে আসছে এই তোষকের টাকাগুলো ব্যাংকে আনতে। কারণ ব্যাংকে আসলে সেই টাকা দিয়ে লোন দেয়া যায় আর লোন দেয়া গেলেই সেই টাকা বাজারে প্রবেশ করে। কিন্তু এইযে মালসাহেব কর বসাইলেন, তার ভারে হয়তো বেচারা বাংলাদেশ ব্যাংকের সব কষ্ট ভেস্তে যাবে।
বিনিয়োগবান্ধব উন্নয়নের বদলে সরকার এবার একগাট্টি টাকা খরচ করতেসে স্ক্যান্ডাল কুইন-রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলা বাচায়ে রাখতে। এখনো পর্যন্ত গত সাত বছরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলো থেকে মোট ৩০ হাজার কোটি টাকা চুরি হয়েছে। এতোগুলো কেলেঙ্কারি এ পর্যন্ত ঘটেছে যে এক নিশ্বাসে এর সবগুলো বলে ওঠা কঠিন ব্যাপার। তারপরেও একটা তালিকা দেয়ার চেষ্টা করা যায়-প্রিয় পাঠক-চেষ্টা করুন তো একদমে সবগুলো শব্দ করে বলে শেষ করতে।
রেডি? এক, দুই, তিনঃ সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্কের চার হাজার কোটি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের এক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ, বেসিক ব্যাংকের ৪৯৩ কোটি ১৩ লাখ অযাচাইকৃত ঋণ প্রদান কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপ কেলেঙ্কারি, জনতা ব্যাংক থেকে ১২ দশমিক ৯৬ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে ওয়েস্টমন্ট পাওয়ারের মালিকের অন্তর্ধান, ২০০৬ সালে হাওয়া ভবন সম্পৃক্ত মানুষজনের ৫৯৬ কোটি টাকা তছরুপ, এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভ চুরি।
এতোগুলো বেহিসাবি ঋণ দেয়ার পরেও এই সবগুলো ব্যাংক বাজারে টিকে আছে কারণ প্রতি বছরে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে এদের মূলধন পূনর্গঠন করে দিচ্ছে। এই বছরেও দিনমজুরের দেয়া ভ্যাটের ১৫ হাজার কোটি টাকা এই কাজে ঢালা হচ্ছে।
মালসাহেব আবার এও বলছেন যে বিনিয়োগের অভাব কালো টাকার দোষ।
কিন্তু টাকা আবার কালো কেমন হয়? টাকাকে কালো বলা হয় যখন মানুষ সেই টাকার উপর ট্যাক্স দেয়না। এখন সরকার যদি সেই টাকার গন্ধ পায়-তাইলে তো সরকার সেটা মেরে দিবে। কাজেই যারা কালো টাকার মালিক-তারা সেই টাকা পাচার করে সিঙ্গাপুর আর মালয়েশিয়ায় গিয়ে ইনভেস্ট করে।
কেনো ইনভেস্ট করে জানেন? কারণ সিঙ্গাপুরে কর্পোরেট ট্যাক্স রেট ১৭ পারসেন্ট যেইটা বাংলাদেশের ট্যাক্স রেটের অর্ধেকেরও কম।
আর এইদিকে আমাদের দেশে উদ্যোক্তাদের সাহস আর গার্মেন্টস কর্মীদের পরিশ্রমে ভর করে যে নতুন এশিয়ান টাইগার হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে-একের পরে এক ট্যাক্সের বোঝা চাপিয়ে সেই স্বপ্নকে ভেস্তে দেবার অবস্থা সৃষ্টি করছেন মালসাহেব।
যেই গার্মেন্টস বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে, সেই গার্মেন্টস খাতের উপর বাড়তি কর চাপানো হয়েছে। যেই ফাস্টফুড ইন্ডাস্ট্রিতে হাজার হাজার তরুণ এখন সাহসে বুক বেধে অর্থ বিনিয়োগ করছে তার উপর ১০ শতাংশ শুল্ক বসানো হচ্ছে।
অথবা এইটাও হইতে পারে যে ফুডব্যাংক গ্রুপের চকচকে রিভিউ পড়ে চাপ সামলাও তে খেতে গিয়ে মাল সাহেব চাপ সামলাতে ব্যর্থ হয়ে দেশী গার্মেন্টস থেকে কেনা পায়জামা নোংরা করেছেন এবং অতঃপর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে এই দুই খাতের উপর ট্যাক্স বসানোর চেষ্টা করেছে।
কিন্তু এই যে সরকার এত্তো এত্তো কর আদায় করছে-কেনো করছে? এই পয়সা কোথায় যাচ্ছে? এই পয়সা দিয়ে কি জনগনের শিক্ষা, চিকিৎসা অথবা অবকাঠামোর উন্নয়ন করা হচ্ছে? তা কিন্তু হচ্ছে না। এই আদায়কৃত করের একটা বিরাট অংশ যাচ্ছে সরকারী আমলাদের বেতন-ভাতা আর পেনশনে। কেনো? যাতে করে আমলা মহল থেকে সরকারী কর্মকান্ডের কোন প্রতিবাদ না আসে। কারণ আমলারা যদি মন্ত্রীসান্ত্রীদের হয়ে কামলা খাটা বন্ধ করে দেয়-তাহলে সরকার যতই হম্বিতম্বি করুক-আর এই দেশের ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে না। এইজন্যেই কয়েক ধাপে সরকারী চাকুরিজীবিদের বেতন বাড়ানো হচ্ছে।
কিন্তু বেতন বাড়ানোটাও ভীষণ একটা ভাঁওতা কারণ বাড়তি বেতনের পয়সা দিয়েও বাড়তি জিনিস কেনা যাচ্ছেনা। তার কারণ হচ্ছে নিয়ন্ত্রণ ছাড়িয়ে যাওয়া মূল্যস্ফীতি। তার একটা কারণ হইলো যত্রতত্র বেহুদা ট্যাক্সের বোঝা চাপায়ে দেয়া-আর আরেকটা হলো বৈদেশিক ঋণ অনুদানের উপর নির্ভরশীলতা।যখন দেশে বিনিয়োগ বাড়েনা আর একই সাথে বিদেশ থেকে অর্থনীতির সহ্যক্ষমতার অতিরিক্ত পয়সা এনে জোর করে ঠুইসসা ঢুকানো হয়-তখনই এই মূল্যস্ফীতিটা ঘটে। সেই দুই ঝামেলার কোনটাই কিন্তু এই বাজেটে কমেনাই-দুইটাই বাড়সে। এই বাজেটে ৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক সহায়তার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হইসে যেটা কিনা গত চার বছর মিলায়েও আনা যায়নাই।
আসলে সরকার মজা পাইসে। কয়েকদিন আগে ইন্ডিয়া আর চায়নার মাঝে কাইজ্জা লাগায়ে দিয়ে দুইদিক থেকেই পয়সা নিয়ে মনে করতেসে যে এই কাজ আরও করে ইচ্ছামতন বাজেট ফুলায়া ফাঁপায়ে তোলা যাবে। কিন্তু এইযে অনুদান আর ঋণ দেখা যায়, এগুলা কিন্তু ফ্রী আসে না। এগুলার সাথে অনেক প্রত্যক্ষ শর্ত আর পরোক্ষ গর্ত থাকে। যেমন কিনা ইন্ডিয়ার থেকে দেদারে টাকা আনার কারণে সরকার যে চাপে আছে সেই চাপে পড়ে সরকার কয়দিন আগে বিনা টেন্ডারে ভারতের রিলায়েন্স গ্রুপকে ৮১ হাজার কোটি টাকার বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ দিয়ে দিসে। আর আইএমএফ বিশ্বব্যাংক থেকে নিলে তো আর দেখতে হবে না-স্ট্রাকচারালি এডজাস্ট করে একেবারে বাংলাদেশের উন্নতিরে এক্কেবারে দাবড়ায়ে দেবে।
আর এই ভ্যাট আর আবগারী শুল্ক নিয়ে আমরা প্রতিবাদ করতে পারছি না কারণ মালসাহেবের মতন রাজনীতিবিদেরা ইচ্ছা করে আমাদেরকে বিভাজিত করছেন। একটা অদৃশ্য দ্বন্দ আমাদের মাঝে তৈরি করার চেষ্টা করছেন। তিনি বলছেন যে যার ব্যাংকে এক লাখ টাকা আছে সে বড়লোক-তার থেকে ট্যাক্স মেরেই দেয়া যায়-কিন্তু সেই ট্যাক্সের টাকা দিয়ে গরীবের সন্তানের শিক্ষার দায়িত্ব নিচ্ছেন না। ১৫% পর্যন্ত ভ্যাটের বোঝা চাপিয়ে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ঊর্ধ্বে নিয়ে যাচ্ছেন পণ্যের দাম আর ব্যবসায়ীরা আন্দোলন করতে চাইলেই তিনি ভয়ংকর কুৎসিতভাবে তাদের দমন করবার কথা বলছেন।
আমাদের এই রাজনৈতিক শ্রেনী প্রায়শই ভাব ধরে যা তারা রবিনহুড গোত্রের কেউ। তারা ভাব ধরে যে ধনীরা খুব খারাপ মানুষ আর সুমহান সরকার এসে ধনীর টাকা গরীবদের দিয়ে দেবে। কিন্তু সত্যিকারে সরকার ধনী আর গরীব উভয়ের থেকে টাকা নিয়ে নিজে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যে সবধরণের অপ্রয়োজনীয় অনুন্নয়ন ব্যয় করে বেড়ায়। সত্যিকারের রাজনৈতিক শ্রেনী তাদের পেশিশক্তির দেমাগ দেখিয়ে দেশের সাধারণ জনগণকে বারবার লুটে নেয়।
কাজেই আমাদের একত্র হতে হবে এই রাজনৈতিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে। তারা যাতে কোনভাবে আমাদের মাঝে বিভাজন তৈরি করতে না পারে। যে অর্থনীতি আমাদের সাহসী উদ্যোক্তা আর পরিশ্রমী শ্রমিকেরা গড়ে তুলেছে-সেই অর্থনীতি যাতে কোনভাবেই সুবিধাবাদি রাজনীতিবিদেরা এসে ধ্বংস করতে না পারে সেই লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। আর সেটা তখনই সম্ভব হবে যখন আমরা বুঝতে পারবো যে আমাদের সেই একাত্তরের মতন আমাদের আজকের সংগ্রামও মুক্তির সংগ্রাম। লাগামছাড়া ক্ষমতাধর উদ্যোক্তা আর শ্রমিকের থেকে একাধারে শোষণ করে যাওয়া পেশিশক্তিশালী রাজনীতিবিদদের থেকে মুক্ত হয়ে নিজেদের ভাগ্য নিজেদের হাতে তুলে নেবার সংগ্রাম।
আমরা যাতে সেই লক্ষ্যে একসাথে কাজ করতে পারি আর রাজনীতিবিদদের শোষণের সামনে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে বলতে পারিঃ রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বে জনতা!
সবাইকে ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্যে।