পরিচয়ের ইজারা বা জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধেঃ মুক্তিবাদের সমাজতত্ত্ব

যখন আমি গোটা পৃথিবীর মানচিত্রের দিকে তাকাই আর ভারতীয় মহাসাগরের একটি ছোট খাঁজের মাথায় একটি চীরচেনা বদ্বীপ ঘিরে আঁকা রেখাটি দেখতে পাই-তখনি আমার বুকের মাঝে একধরণের উষ্ণতা সৃষ্টি হয়। যখনই উন্নয়নশীল বিশ্বের কোন আলোচনায় বাংলাদেশের গ্রামের কোন মায়ের নির্লজ্জ মায়াকাড়া হাসি ভেসে ওঠে-আমার চোখে পানি চলে আসে। সারা পৃথিবীর সবচেয়ে বিলাসবহুল দুটি শহরে ভাগাভাগি করে বসবাস করেও আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে বসবাসের অযোগ্য শহরটিকেই বসবাসের জন্যে অনুকূল বলে মনে হয়। তার মানে কি এই যে ঢাকা শহর, বা চট্টগ্রাম শহর আসলেই নৈর্ব্যক্তিকভাবে সকল হিসাবে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো শহর? যদি গণপরিবহন, দূষণ, পয়নিষ্কাশন-ইত্যাদি মাত্রা দিয়ে মাপা হয় তাহলে অবশ্যই আমার প্রাণের শহরগুলো অনেক পিছিয়ে থাকবে।
তবে ভালোবাসা তো নৈর্ব্যক্তিক নয়-ভালোবাসা নিতান্ত ব্যক্তিগত। কাজেই সব নৈর্বক্তিক মাত্রা পেরিয়ে যা কিছু আমার কাছে আমার তার জন্যে যে ব্যক্তিগত ভালোবাসাটুকুন অটুট থাকে-আমরা সেইটিকে বলি দেশপ্রেম। সংজ্ঞাগতভাবেই এটি একটি বেহিসেবী আবেগ-এর কোন হিসেবকিতাব লাগে না-তথ্যপ্রমাণ লাগেনা।
তবে এই ব্যক্তিগত আবেগের তীব্রতায় যদি আমি আসলেই নৈর্ব্যক্তিকভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করি যে আমার দেশ, আমার জাতি আর আমার মানুষ আসলেই সব হিসেবে বিশ্বের সবার চেয়ে সেরা- তাহলেই সেটা হয়ে যেতে থাকবে জাতীয়তাবাদ। কাজেই জাতীয়তাবাদ আর দেশপ্রেমের মাঝে তফাৎ করাটা প্রায়শই বেশ কষ্টকর হয়ে পড়ে। দুটিরই ফলাফল সমধর্মী তবে সেই ফলাফলে পৌঁছানোর প্রক্রিয়াটি ভিন্ন। কাজেই একজন জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিকের আর একজন মুক্তিবাদী (অজাতীয়তাবাদী) দেশপ্রেমিকের আবেগের বহিঃপ্রকাশ হবে ভিন্ন। একজন ব্যক্তিবাদী দেশপ্রেমিককে যদি কেউ বলে যে ভাই ঢাকা শহরের উন্নয়ন ব্যয় পাকিস্তানের উন্নয়ন ব্যয়ের দেড়গুণ- তাহলে সে খুব ব্যথিত হবে-কিন্তু রাগান্বিত হবে না। যদি এই দায় সত্য হয়-সে সেটা মেনে নেবে এবং দেশের প্রতি আবেগের তানে এই সমস্যা মোকাবিলা করবার কোন একটা উপায় খুঁজতে শুরু করবে। কিন্তু একই অভিযোগ যদি একজন জাতীয়তাবাদীর কাছে করা হয়-তাহলেই সে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবে- কেননা তার জাতির সর্বৈব শ্রেষ্ঠত্বই তার পরিচয়ের মূলভিত্তি। কাজেই উন্নয়ন ব্যয় সংক্রান্ত সমালোচনা এড়াতে সে সমালোচনাকারীকে রাজাকার দেশদ্রোহী বলে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করে বসবে, পুরো তথ্যটাকেই ভুয়া বিরোধীদলের ষড়যন্ত্র বলে চালিয়ে দেবে অথবা পাকিস্তানের আরও দশটা ত্রুটি বের করে বাংলাদেশকে তবুও পাকিস্তানের চেয়ে মহত্তর প্রমাণ করার চেষ্টা করবে যদি সেই আলোচনা এই সমালোচনার সাথে কোনভাবেই সম্পর্কিত নয়। এর প্রত্যেকটি পদক্ষেপই সেই জাতীয়তাবাদীর ভাবাদর্শগত মূলভিত্তিকে-অর্থাৎ বাংলাদেশ সবার চেয়ে সবদিক থেকে সেরা-সেই গোয়ার্তুমিকে রক্ষা করে তবে সত্যিকারে বাংলাদেশকে উন্নত করবার কাজে কোন ভূমিকা রাখেনা।
ঠিক একই কারণে জাতীয়তাবাদ ইতিহাস বিকৃত করতে চায়, ইতিহাসের ভাংচুর ঝাপসা করে দিয়ে একটা একরৈখিক রূপকথা তৈরি করে যেটা কিনা সেই জাতীয়তাবাদের ভাবাদর্শকেই আরও শক্তিশালী করে তোলে। বিএনপি সরকার খুব নোংরা ভাবে স্বাধীনতার ঘোষক সংক্রান্ত বিষয়ে ইতিহাসকে ঘোলা করেছে আর আওয়ামী লীগও একাত্তর পূর্ববর্তী রাজনৈতিক ইতিহাসের জটিলতা ঝাপসা করে একটি সহজ সরল তাইরে নাইরে ইতিহাস পয়দা করেছে যেটা শুনলে মনে হয় সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর জুড়ে বাঙালি জাতি একত্র হয়ে টানা স্বাধীনতার লক্ষ্যেই সংগ্রাম করে গেছে। এইজন্যে স্বাধীনতার ঘোষণার সত্যিকারের ইতিহাস বা সাতই মার্চের ভাষণের জিয়ে পাকিস্তান বিতর্ক চোখে পড়লেই আমরা চোখ বুজে ফেলি-আর যে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাচ্ছে তার চোখ গালিয়ে দিতে চাই। অর্থাৎ আমাদের দুইটি প্রধান রাজনৈতিক ঘরানাই সমান পরিমানে জাতীয়তাবাদী। বিএনপি নিজের নামেই সেটা সরাসরি স্বীকার করে বসে থাকে আর আওয়ামী লীগ আওয়াম বলতে একটা স্বনির্বাচিত সুশীল গোষ্ঠীকে বাছাই করে তাদের সুবিধামাফিক গড়ে তোলা জাতীয়তাবাদকে নিজের করে নেয়।
তার মানে এই নয় জাতীয়তাবাদ সবসময়ই অদরকারী একটা ভাবাদর্শ। যুদ্ধের সময়ে জাতীয়তাবাদ খুব বড় একটি শক্তি। দেশপ্রেমের জন্যে জীবন দেয়া যায়-কিন্তু জীবন নিতে গেলে জাতীয়তাবাদ প্রয়োজন হয়। যেমন আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের অনেক যোদ্ধা তীব্র জাতীয়তাবাদের থেকেই অস্ত্র হাতে নিজেছিলেন। বিশ্বের সর্বাধুনিক সেনাবাহিনী নিয়েও কেবলমাত্র জাতীয়তাবাদের শক্তির কারণে ভিয়েতনামের কাছে পরাজিত হয় আমেরিকা।
তবে যুদ্ধের জন্যে খুব ভালো অস্ত্র বলেই হয়তো শান্তির সময়ে জাতীয়তাবাদ বেশ ঝামেলাময় একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কেননা উৎপত্তিগতভাবেই জাতীয়তাবাদ একটি সংঘর্ষপন্থী ভাবাদর্শ- অর্থাৎ কিনা জাতীয়তাবাদী হয়ে নিজের গোষ্ঠীকে ভালবাসতে হলে অন্যান্য গোষ্ঠীকে হয় ঘৃণা করোতে হয় অথবা তাচ্ছিল্য করতে হয়। ঠিক এই কারণেই জাতীয়তাবাদীদের খুব মোটা দাগে নিজের জাতি আর অন্যের জাতিকে চিহ্নিত করে নেয়া লাগে। তবে মানবিক অভিজ্ঞতাকে মোটা দাগে আমরা তোমরায় ভাগ করা বেশ কঠিন একটা ব্যাপার। কাজেই জাতীয়তাবাদী জাতিনির্মাণের কাজে অনেক সময়েই অনৈতিকভাবে অনেককে বাদ দিয়ে জাতি গড়ে ফেলা হয়।
যেমন কিনা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে আমরা পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত বিজয় হিসেবে গণনা করে এই দেশের অভ্যন্তের বাঙ্গালি জাতি নামের একটি জাতি নির্মাণ করার চেষ্টা করলাম যারা হবে এই দেশের হর্তাকর্তা। তবে সেই জাতি নির্মাণ করতে গিয়ে আমরা দুই ধরণের মুক্তিসংগ্রামীকে হিসেবের বাইরে নিয়ে গেলাম- ইসলামপন্থীদের যারা পাকিস্তান থেকে মুক্তি চাইলেও ইসলামভিত্তিক শাসনব্যবস্থার পতন চাননাই আর আদিবাসী অবাঙ্গালীদের যারা পাকিস্তানের শোষণ থেকে মুক্তি চেয়েছিলো আর আশা করেছিলো যে নতুন স্বাধীন দেশটা হবে তাদের স্বাধিকারের দেশ। একাত্তরের পরপর মাথা গুঁজে জাতীয় সংগীত, জাতীয় কবি, রাষ্ট্রভাষা ইত্যাদি দিয়ে জাতিনির্মাণ করতে করতে আমরা খেয়াল করিনাই যে সেই জাতির সংবিধানে আমরা আদর্শগত, ভাষাগত আর সংস্কৃতিগত সংখ্যালঘুর অস্ত্বিত্বই স্বীকার করিনাই- ঠিক নব্য স্বাধীন পাকিস্তানের মতন। একই ভাবে হুটহাট পাকিস্তানের প্রতি তীব্র ঘৃণায় ভর করে বাংলাদেশকে ভিন্ন একটি জাতি বানাতে গিয়ে আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা আর সমাজতন্ত্র আমাদের সংবিধানের মূলনীতি করে বসে থাকলাম- এতোটুকু ভেবে দেখলাম না যে সেটিতে ইসলামপন্থীদের সহমত আছে কিনা। যারাই দ্বিমত পোষণ করলো তাদেরকে আমরা সত্যিকারের বাঙ্গালী না-বলে পার করে দিলাম। তাই কয়েক দশকের মাঝেই আমাদের অবজ্ঞা ইতিহাসের যমদূত হয়ে ফিরে এলো-পার্বত্য চট্টগ্রামে গড়ে উঠলো শান্তিবাহিনী আর বাংলাদেশের প্রান্তিক জনপদে শিকড় ছড়ালো ইসলামভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠন।
তবে তার কিছুদিন পরেই আমরা আবিষ্কার করলাম যে বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদও খুব জুতসই হচ্ছেনা- কারণ পশ্চিমবঙ্গের মানুষজনও বাংলায় কথা বলে। কাজেই আমাদের নিজেদেরকে আবার আলাদা করোতে হবে। এবার আমরা নিজেদের নাম দিলাম বাংলাদেশী। কিন্তু এইবারে আমরা আমাদের জাতিনির্মাণের মূলভিত্তি নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলাম কেননা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ আর ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ দুইটাই ততদিনে ভেঙ্গে পড়েছে। তাহলে কি সেই একক সংজ্ঞাগত মাত্রা যা দিয়ে আমরা বাংলাদেশীদের বাকি সকল দেশীদের থেকে আলাদা করতে পারবো? কে সেই তোমরা যাদেরকে ঘৃণা করে আমরা আমরা হতে পারি? এই প্রশ্নে আমরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেলাম। একদল সিদ্ধান্ত নিলাম যে ঘৃণা করবার জন্যে পাকিস্তান বেশি জুতসই আর আরেকদল সিদ্ধান্ত নিলো যে ঘৃণা করবার জন্যে ভারত বেশি জুতসই। সেই থেকে দশক দশক ধরে আমরা ভারতবিদ্বেষ আর পাকিস্তানবিদ্বেশ অথবা মতান্তরে ভারতপন্থা আর পাকিস্তানপন্থার সংঘাতের ওপর আমাদের ঠুনকো জাতীয়তাবাদ টিকিয়ে রেখেছি। আর যখনি আমাদের মধ্যে থেকেই কেউ আমাদের কোন একটা দোষ ধরিয়ে দিয়েছে-কোন সমস্যার সমাধান করবার জন্যে আওয়াজ তুলেছে-তখনই আমরা তাকে ভারতপ্রেমী রাজাকার বা পাকিস্তানপ্রেমী রাজাকার বলে পার করে দিয়েছি। এক জাতীয়তাবাদের ভিতরে আমরা হয়ে পড়েছি দুইটি বিদেশী রাষ্ট্রকে ঘৃণা করে টিকে থাকা গোষ্ঠী আর এই দুইটি গোষ্ঠীর ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে আমাদের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে।
ঠিক এই কারণে আমরা পরস্পর বিদ্বেষী দুইটি জাতীয়তাবাদী দল পেয়েছি যারা যথাক্রমে ভারত ও পাকিস্তানকে ঘৃণা করে বেঁচে থাকে কিন্তু এসবের ভীড়ে বাংলাদেশকে ভালোবেসে দেশের স্বার্থে কাজ করবার সময় আর খুঁজে পায়না।
তবে আমি এই পরিস্থিতি সৃষ্টির দায় কোনভাবেই সাধারণ মানুষের ঘাড়ে তুলে দিতে চাইছি না। আমরা মানুষ হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক। নিজেদের পছন্দের মানুষকের নিয়ে এক একটা সম্প্রদায় গড়ে তুলতে আমরা ভালোবাসি। এই সম্প্রদায়ের কোন ধরাবাধা নিয়ম থাকেনা-কোন জাতীয়তাবাদী পরিচয় থাকেনা। একজনের সম্প্রদায়ে নানান ভাষার, ধর্মের, সংস্কৃতির আর জাতীয়তার লোক থাকতেই পারে। তবে যেহেতু আমরা স্বাভাবিকভাবেই আমাদের সমমনা মানুষদের সাথে থাকতে পছন্দ করি-সেহেতু আমাদের এই স্বতঃস্ফূর্ত সম্প্রদায়ের অনেকগুলোই আমাদের ধর্ম, ভাষা আর সংস্কৃতিকে ঘিরে গড়ে ওঠে। কেবলমাত্র সম্প্রদায়ের অস্তিত্বই কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার উৎস নয়। ভারতে শতবছর ধরে অভিবাসী মুসলমানদের সাথে হিন্দুরা মিলেমিশে থেকেছে-অনেকে নিজের মতে টিকে থেকেছে-ধর্মান্তরিত হয়েছে অনেকে-সেটা বিশেষ অন্তর্ঘাতের কারণ হয়নাই। কিন্তু ঠিক যখন উপনিবেশ স্থাপনকারী গোরারা এসে আমাদের সম্প্রদায়গুলোর মাঝে ইচ্ছাকৃত ক্ষমতার বৈষম্য সৃষ্টি করলো-তখনই আমাদের সম্প্রদায়গুলো দাঙ্গাবাদী গোষ্ঠীতে পরিণত হতে থাকলো। সাম্প্রদায়িকতা একটি গোষ্ঠীবাদী ধারণা যেটা সম্প্রদায়ের রাজনীতিকিকরণ থেকে জন্ম নেয়।
আর রাজনীতিবিদেরা এই ছোট ছোটো সম্প্রদায়গুলোকে একত্র করে একটা গোষ্ঠী হিসেবে দাঁড়া করানোর জন্যে সবসময় উন্মুখ হয়ে থাকে। কারণ যদি একজন মানুষকে তার ব্যক্তিগত বিচারবুদ্ধি আর পরিচয় ত্যাগ করে একটি গোষ্ঠীর বিচারবুদ্ধি আর পরিচয়ে মিশে যেতে রাজি করিয়ে ফেলা যায়-তখন তাকে রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে আর তাকে ব্যক্তিগতভাবে রাজি করাতে হয়না-বরং তার গোষ্ঠীনেতাকে রাজি করাতে পারলেই চলে। এইজন্যে রাজনীতিবিদেরা সমমনা সম্প্রদায়গুলোকে একত্র করে আর গোষ্ঠী তৈরি করতে চেষ্টা করে। যেমন ভারতে কেবল বর্ণ অনুযায়ী আর বাংলাদেশে কেবল ধর্মীয় মৌলবাদীতা অনুযায়ী বিশেষ কিছু গোষ্ঠীর নেতাদের বাগে আনলেই সংখ্যাগুরু জনগণকে বাগে এনে ফেলা যায়। এই উপায়ে ‘জাতীয়’ নেতাদের বদান্যতায় গোষ্ঠীনেতাদের পকেটে পোঁরে আর তাদের মুখ মানুষকে শোনায় যে গোষ্ঠীর বাইরে যারা রয়েছে তারা গোষ্ঠীর ভিতরের মানুষের অস্তিত্বের জন্যে হুমকি। এমন করে তারা পড়শিকে পড়শির বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়- বন্ধুকে দিয়ে বন্ধুর বাড়িতে আগুন জ্বালায় আর ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাইকে দাঁড় করিয়ে দেয়। ঠিক এইভাবেই পাকিস্তানি দ্বিজাতীতাত্ত্বিকরা মুসলমানদের শুনিয়েছিল যে হিন্দুরা তাদের জন্যে হুমকি আর ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা হিন্দুদের শোনাচ্ছে যে মুসলমানেরা তাদের সবকিছু কেড়ে নিতে চায়। আর তাদের এইসব পদ্ধতি অনেক সাফল্য এনে দিয়েছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা নির্বাচন জিতে গিয়েছে আর পাকিস্তান তো আস্ত একটা দেশ দাঁড়া করিয়ে ফেলেছে।
তার মানে কিন্তু এই নয় যে পাকিস্তানের মুসলমানরা বা ভারতের হিন্দুরা আসলেই এক জাতি হয়ে গিয়েছে। এক পাকিস্তানের মধ্যেই আহমদী আর সুন্নির মাঝে, ভূমিপুত্র আর মোহাজিরের মাঝে, সিন্ধি আর বেলোচের মাঝে প্রচুর ফারাক রয়ে গিয়েছে। একই ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের হিন্দুর সুখ দুঃখের সাথে উত্তর প্রদেশের হিন্দুর সুখদুঃখের প্রচুর ফারাক। সত্যিকারের পৃথিবীতে একজন মানুষ আর আরেকজন মানুষের সব সুখ দুঃখ আর অভাব অভিযোগ একই হওয়া নিতান্তই অসম্ভব। একই দেশে একই শহরে একি ভাষার একই ধর্মের একই সংস্কৃতির একই রকম দেখতে দুইজন মানুষ হয়তো জীবন থেকে দুই ধরণের অর্জন চায়- একজন হয়তো জীবনে প্রচুর প্রবৃদ্ধি চান আরেকজন হয়তো চান স্থিতিশীলতা। কাজেই তাদের দুইজনকে যদি গোষ্ঠীনেতারা একই গোষ্ঠীতে ফেলে দিতে চান তাহলে কমপক্ষে একজনের এবং সম্ভবত দুইজনেরই স্বার্থহানী করতে হবে। তবে নিশ্চিতভাবে যার স্বার্থহানী হবেনা সে হলো গোষ্ঠীনেতা।
গোষ্ঠীর সদস্যদের নিজের স্বার্থহানী করে যে গোষ্ঠীস্বার্থ আদায় করতে প্রলুব্ধ করা হয়-সেটা অধিকাংশ সময়েই গোষ্ঠীনেতার ব্যক্তিস্বার্থ কেননা গোষ্টীর স্ব-বলে কিছু নেই, কাজেই স্বার্থ বলেও কিছু নেই।
ঠিক এই কারণে আমাদের গোষ্ঠীবাদী চিন্তাধারা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। ব্যাপারটা খুব কঠিন কেননা শত বছরের শোষণ আমাদের গুটি বেঁধে অস্ত্র ধরতেই শিখিয়েছে বারংবার। তবে যখন অস্ত্রের ঝনঝনানি থেমে আসে-তখনই শোনা যায় আজানের ধ্বনি আর তার পর তার পাশের উঠোনে মন্ডপের ঢাক। গোষ্ঠীনেতাদের বকবকানি থেকে কান সরিয়ে যদি একটাবার আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের সাথে কথা বলি-তাহলেই বুঝতে পারবো যে ভালোবাসার জ্বালানীতে গড়া সম্প্রদায় ঘৃণার আগুনে পোড়া গোষ্ঠীর চেয়ে কতটা শক্তিশালী।
তাই যখনই আমাদেরকে কেউ গোষ্ঠীর প্যাকেটে পুরে কোন একটা আবেগ বেচে দেয়ার চেষ্টা করবে-আমাদের তার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাতে হবে। প্রশ্ন করতে হবে যে ব্যক্তি হিসেবে নিজের বিবেচনায় এই প্রশ্নে আমার অবস্থান কোথায়। কেউ যদি বলে রোহিঙ্গা সংকটে আমার ব্যথিত হওয়া উচিত কারণ আমি মুসলমান তাহলে আমি তার দিকে চোখ কোড়া করে তাকাবো-কেউ যদি বলে রামুর আক্রমণে আমার চোখে পানি আসা উচিত কারণ আমি বৌদ্ধ আমি তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবো-কেউ যদি বলে মন্দির ভাঙ্গলে আমার হৃদয় ভাঙ্গা উচিত কারণ আমি হিন্দু আমি তার থেকে দূরে সরে আসবো। আমি চিন্তা করে দেখবো একজন আমি হিসেবে-একজন নিতান্ত ব্যক্তিগত ব্যক্তি হিসেবে-আমার হৃদয় ভাঙ্গে কিনা, আমার চোখে পানি আসে কিনা আর আমি ব্যথিত হই কিনা। কারণ সেই আবেগই হবে সত্যিকারের আবেগ আর সেই আবেগের নাম করে আমাকে কেউ খুব গোপনে একদলা ঘৃণা বেচে দিতে পারবে না।
মুক্তিবাদী হতে গেলে-গোষ্ঠীনেতাদের হেজেমনিক কর্তৃত্বের থেকে স্বাধীন হতে হলে-আমাদের নিজেরটা নিজের ভাবতে শিখতে হবে। আমাদের মগজ যেনো আর কেউ ভাড়া করতে না পারে-আমাদের পরিচয় যেনো আর কেউ ইজারা নিতে না পারে আর আমাদের মনুষ্যত্ব যেনো আর কারো মালিকানায় চলে না যায়।

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.