চার দশকে মোট রাষ্ট্রপতির ক্ষমার চেয়ে লীগের এক দশকে বেশি ক্ষমার রেকর্ডঃ বাড়লো আরো এক

সংবাদঃ

সম্প্রতি যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফ রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় মুক্তি পেয়েছেন। কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে গত রোববার তাঁর সাজা মওকুফ করা হয়। ছাড়া পেয়েই গোপনে দেশ ছেড়েছেন তিনি। জোসেফ দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তাঁকে ক্ষমা করার বিষয়টি জানাজানি হয়।এর আগে সংসদে এক প্রশ্নোত্তর পর্বের উত্তরে আসাদুজ্জামান খান জানান মহাজোট সরকারের মেয়াদে ২০১০ সালে একদিনে একই মামলার ২০ জনসহ ২১ জন মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত আসামির দণ্ড মওকুফ করা হয় রাষ্ট্রপতির আওতাধীন ক্ষমার ক্ষমতা ব্যবহার করে। এছাড়া ২০০৯ সালে একজন ও ২০১১ সালে একজনসহ মোট ২৩ জন মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামির সাজা মওকুফ করা হয়েছে। জোসেফের সাজা মওকুফের ঘটনায় এই রেকর্ডে যোগ হলো আরো একটি নাম।

উল্লেখ্য, নব্বইয়ের দশকে মোহাম্মদপুর এলাকায় ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জোসেফ। তখন আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ‘সেভেন স্টার’ গ্রুপে যোগ দেন তিনি। রাজধানীতে তখন ‘সেভেন স্টার’ গ্রুপ ও ‘ফাইভ স্টার’ গ্রুপ দাপিয়ে বেড়াত। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার এর আদিলুর রহমান খানের দেয়া তথ্য অনুযায়ী আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের বর্তমান মেয়াদে যাদের মৃত্যূদন্ড মওকুফ করা হয়েছে, তাদের প্রত্যেকেরই কোন না কোন ভাবে আওয়ামী লীগের সাথে সম্পৃক্ততা রয়েছে।

এ ব্যাপারে সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক মনে করেন, মৃত্যুদন্ড মওকুফ করার ক্ষেত্রে কোন মাপকাঠি না থাকায় নানান প্রশ্ন উঠছে। এছাড়া রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাবলে এই ক্ষমা করার কথা বলা হলেও কখনও এ ব্যাপারে যুক্তি বা কারণ প্রকাশ করা হয় না বলেও সন্দেহ দেখা দেয়। তিনি আরও বলেছেন, ‘রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাবলে ক্ষমা করার কথা বলা হলেও সিদ্ধান্ত আসে সরকার থেকেই। আইন অনুযায়ী সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হয়। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সব বিষয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আইন মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয় এবং প্রধানমন্ত্রীর মতামত পাওয়ার পর তা যায় রাষ্ট্রপতির কাছে।’ তার ভিত্তিতেই রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত আসে বলে মি. মালিক উল্লেখ করেছেন।

আলোচনাঃ

চার দশকে মোট ক্ষমার চেয়ে এক দশকে বেশি ক্ষমা কেবলমাত্র আমাদের রসিক রাষ্ট্রপতির বেরসিক দিকটিকেই উন্মোচিত করে দেয়না–সাথে সাথে আমাদের দেশের বিচার বিভাগের ধ্বজভঙ্গ অবস্থানটিকেও জাতির সামনে তুলে ধরে।

বর্তমান বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা চলছে বিচার বিভাগের বাইরের একটি জায়গায়। বিগত কয়েক বছর ধরেই বিচার বিভাগকে পরাধীন করবার বা নতজানু করে আনবার একটা প্রচেষ্টা বাংলাদেশ সরকারের নির্বাহী বিভাগ করে আসছে। এর সবচেয়ে বড় বহিপ্রকাশ হিসেবে সরকারের অপছন্দের রায় দেয়াতে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতিকে হয়রানীর ঘটনায় আমরা দেখেছি। তার পরপরই ঘটে যাচ্ছে একের পর এক বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড, যেখানে আদালতের ধার না ধেরেই একের পর এক “মৃত্যুদন্ড” কার্যকর করে যাচ্ছে নির্বাহী বিভাগ।

এর আগেথেকেই ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে আর ২০১৪ সালের বিরোধীদলবিহীন নির্বাচনের ফলস্বরূপ আইন প্রণয়নকারী বিভাগ, তথা জাতীয় সংসদের ওপর নির্বাহী বিভাগের প্রধান এবং আওয়ামী লীগের দলীয় প্রধানদের ছিলো একচ্ছত্র আধিপত্য। এখন বিচার বিভাগকেও একদিকে ক্রসফায়ার আর অন্যদিকে দন্ড মওকুফের মাধ্যমে একেবারে ক্ষমতাহীনতার দারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে সরকার। দেশে এখন আইন তৈরি, সেই আইন প্রয়োগ এবং বিচারের দায়িত্ব পালন করছে একটি নির্দিষ্ট দলের নির্দিষ্ট গুটিকয় মানুষ। এরকম একটি পরিস্থিতিতে একটি গণপ্রজাতন্ত্রকে আর গণতান্ত্রিক বা প্রজাতান্ত্রিক, কোনটাই বলা যায়না।

 

লেখকঃ অনুপম দেবাশীষ রায়

মুক্তিফোরাম

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.