জুন ২, ২০১৮:
কয়েক দফা গুলির শব্দ শুনে যখন স্বামীর মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত তখনও মেয়েদের শেষ আশাটুকু বাচিয়ে রাখার চেষ্টা করছিলেন মা। অডিওর শেষদিকে শোনা যায় তিনি শান্ত হয়ে বুঝাচ্ছিলেন “তোমার আব্বুর কিছুই হয়নি”।
বাবাও মেয়ের সাথে শেষ কথা বলার সময় বলছিলেন “বেশিক্ষণ লাগবে না, আমি চলে আসবো আম্মু”। কিন্তু শেষ আশাটুকু আর বেচে থাকেনি। তাহিয়া ও নাহিয়ানের বাবা আর ফিরে আসেনি।
এই হত্যাকান্ডের সবচেয়ে নির্মম ও ভয়ংকর দিকটি হল, প্রশাসন যে একরামুল হককে হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল সেটা তাকে বুঝতে না দিয়ে কিসব জায়গা জমি বিক্রির কথা বলে র্যাব অফিসে ডেকে নেয়া। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হ্নীলার মত নির্জন এরিয়ায়। যাতে ক্রসফায়ার করতে কোন ধরণের অসুবিধা না হয়। অর্থাৎ নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের কোন সুযোগ তো দেওয়া তো দূরের কথা, তাকে ডেকে নেওয়া হয়েছে যে মেরে ফেলার জন্য এটাও বুঝতে দেওয়া হয়নি।
গতকয়েকদিনের ক্রসফায়ারে বাকিদের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর নৃশংসতার চিত্রও হয়তো অনেকটা এরকমই ছিল। অথবা হতে পারে আরো ভয়াবহ।
স্ত্রী আয়েশা বেগম সহ আত্মীয় স্বজন ও দলীয় নেতাকর্মীরা যত দৃঢ়তার সাথেই বলুক, ‘একরামুল হক কোনভাবেই মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল না’ ওসব কথায় কান দেয়ার সময় বা ইচ্ছা কোনটাই প্রশাসনের ছিল না। বরং র্যাব-৭ এর মেজর রুহুল আমিন এই হত্যাকান্ডকে বৈধ বানানোর জোরদার প্রচেষ্টাই করেছেন। তার দাবী হচ্ছে, ‘একরামুল হক মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকার শীর্ষে ছিল। টেকনাফ থানায় তার নামে একটি মাদক সংক্রান্ত মামলা রয়েছে’।
কিন্তু থানায় খোজ নিয়ে জানা যায়, একরামুল হকের নামে যে দুটি মামলা ছিল, তার একটি ২০০৮ সালে আদালত খারিজ করে দেয়। আর মাদক সংক্রান্ত মামলাটিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, একরামুলের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বললেন, কাউন্সিলর একরাম মাদকের সাথে জড়িত থাকার ব্যাপারে নাকি আগেও কয়েক জায়গায় লেখালেখি হয়েছে। তো “কয়েকজায়গার লেখালেখি”কে দলিল হিসেবে গ্রহণ করে মন্ত্রীরাও আজকাল মানুষ হত্যার বৈধতা দিতে শুরু করেছে!
আসলে প্রশাসন হোক অথবা সরকার, কেউই যে এখন আর বিচারবিভাগের উপর আস্থা রাখতে পারেন না চলমান রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ বহন করে। এরউপর আবার প্রধান বিচারপতির সাথে ঘটানো সেই স্ক্যান্ড্যাল ফাস হওয়ার ব্যাপারটা তো আছেই। তাই এই অবস্থায় যদি শত্রুকে অপরাধী সাব্যস্ত করার দায়িত্ব বিচারবিভাগের হাতে তুলে দেওয়া হয় তাহলে বড় বড় রাঘববোয়ালদের ফাসিয়ে দিয়ে মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত করে দেয় কিনা সে ভয়টা থেকেই যায়। যে কোন মূল্যে ‘বোয়ালমাছ’দের বাচিয়ে রাখতে হবে যে!
আচ্ছা ঠিক আছে, সরকারের ভয়ে নাহয় মেনেই নিলাম, কাউন্সিলর একরামুল হক মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন। বিগত কয়েকদিনে আরো যে শতাধিক মানুষকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে তাদেরও অপরাধী বলেই বিশ্বাস করে নিলাম।
তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এই বিশ্বাসকে পাশ কাটিয়েই কিন্তু পুরো বাংলাদেশের মানুষ এখন প্রশাসনের নির্মম হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ করছে। সরকার বিরোধী হয়ে যাবার ভয়ে হয়তো কেউ মাঠে নামার সাহস করছে না। কিন্তু যে মাধ্যমে যতটুকু প্রতিবাদের সামর্থ্য আছে ততটুকু করে মানুষ ঠিকই জানিয়ে দিচ্ছে বিচার বহির্ভূত এই হত্যাকান্ডকে জনগণ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছে।
জনগণ এখন প্রশ্ন তুলছে,
উদ্দেশ্য কি আসলেই মাদকবিরোধী অভিযান? তাহলে গডফাদারদের রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করে দিচ্ছেন কেন? কেন একের পর এক তাদেরকে বিদেশ পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে?
মাদক বিরোধী অভিযানের নাম করে মাদকের ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হচ্ছে না তো?
সময় যত যাচ্ছে প্রশ্নগুলো ততই গুরুতর হয়ে উঠছে।
মুক্তিফোরামে ইমেল করেছেন আশরাফ মাহদি
আপনিও লেখা পাঠান, প্রয়োজনে ব্যবহার করুন ছদ্মনাম। ইমেলঃ muktiforum@gmail.com
ফেসবুকে যোগ দিনঃ www.facebook.com/groups/Muktiforum