কোন ঘটনার সাথে কোনভাবে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের জড়িত থাকার অভিযোগ থাকলেই সেটার আর বিচার হয়না। সেই কারণে দেশের মানুষও আস্তে আস্তে আইন আদালতের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলছে- তারা খুজছে সুইফট জাস্টিসের উপায়, যার থেকে জন্ম নিয়েছে বিচার বহির্ভূত বিচারের সংস্কৃতি। নাসিরনগরের হামলার ঘটনায় দায়িত্ব অবহেলা এমনকি সক্রিয়ভাবে উস্কানি দেয়ার কারণে অভিযুক্ত্ নাসিরনগর থানার ওসি আবদুল কাদেরকে শাস্তি হিসেবে সেই থানা থেকে প্রত্যাহার বা ক্লোজ করা হলো, তিনজন উস্কানিদারা আওয়ামী লীগ নেতাকে দল থেকে বহিস্কার করা হলো, কিন্তু এই কি বিচার?
একজন ওসিকে এক থানা থেকে ক্লোজ করলে অন্য থানাতে আবার ওপেন করাই যায়, আর রাজনীতির পাশাখেলায় কয়দিন পেরোলে বহিস্কারের কথাই বা আর কার মনে থাকে? এই মানুষেরা যদি আসলেই হামলার সাথে জড়িত থাকে তাহলে এদের পুলিশে সোপর্দ করা হয়না কেনো? এদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়না কেন? কেন একটি সংগঠন বা একটি প্রশাসনের কাছ থেকে শাস্তি আসবে? যদি সকল শাস্তি আদালতের বাইরেই সবাই সম্পন্ন করে ফেলে তাহলে আমাদের এতো পরাক্রমশালী বিচার বিভাগ করবেটা কি?
বিচারহীনতার সংস্কৃতির দ্বিতীয় অংশটি হলো এই লোকদেখানো বিচারটুকুনও না হওয়া। নাসিরনগরের ইউএনওর বিরুদ্ধে প্রশাসন এখনও কোন ব্যবস্থা নেয়নি। সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তা হিসেবে নিজস্ব ব্যক্তিগত ফেসবুক একাউন্টে মার্জিত বক্তব্যের সীমা ছাড়ানোর দায়ে সুশান্ত পাল নামের একজন সরকারী কর্মকর্তাকে তড়িৎগতিতে বদলী করা হয়। কিন্তু নাসিরনগরের ইউএনও সাহেব সাংবাদিকদের সাথে অমার্জিত আচরণ করার পর, দায়িত্বরত অবস্থায় এলাকার বিক্ষোভ সমাবেশে অভিযোগ অনুযায়ী উস্কানিমূলক বক্তব্য দেয়ার পরও তার বিরুদ্ধে প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নেয়না। বরং তার চড়ানো সূরে সূর মেলান স্থানীয় সাংসদ এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী জনাম ছায়েদুল হক। তাহলে কি এই বিশেষ ইউএনও কোন বিশেষ কারণে বিশেষ সুবিধা পাচ্ছেন? তার বিরুদ্ধে বারংবার অভিযোগের পরেও কেনো তাকে পুলিশ গ্রেফতার করছে না? ক্রিমিনাল ইনভলভমেন্টের জন্যে না হলেও অন্তত দায়িত্বে অবহেলার কারণে কি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা যায়না।
যায় কেননা নাসিরনগরে মন্দিরের হামলার ঘটনায় সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে প্রতিবেদন দিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্থানীয় প্রশাসনের ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘প্রথম হামলার ঘটনার পর স্থানীয় প্রশাসন সক্রিয় ভূমিকা রাখলে এত ক্ষয়ক্ষতি হতো না। বিষয়টি নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি নাসিরনগরের ইউএনও ও স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গাফিলতি রয়েছে।’ (ইত্তেফাক, ৫ নভেম্বর ২০১৬). তাহলে কেনো প্রশাসনিক শাস্তির পাশাপাশি এদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবেনা।
বাংলাদেশের পুলিশ চাইলে যে এই দুষ্কৃতিকারীদের খুঁজে বের করতে পারে সেটা তারা প্রমাণ করেছে ইতোমধ্যে ৩৩জনকে আটক করে। কিন্তু যারা ধরা পড়ছে তারাই কি মূল পরিকল্পনাকারী নাকি তারা শুধু চুনোপুঁটি? এর আগেও রামুর আক্রমণের ঘটনায় রাজনৈতিক ক্ষমতাসম্পন্ন নেতাদের সংযোগের অভিযোগ থাকলেও তাদের কাউকে আইনের সম্মুখীন হতে দেখা যায়নি। এইদিকে মূল ঘটনার উস্কানিদাতাদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন একজন ক্ষমতাবান মন্ত্রী। তাহলে কি এখানেও জনগণ বিচার পাবেনা? বিচারহীনতার সংস্কৃতি এগিয়ে যাবে আরও গুরুতর হয়ে?
এই দেশের রাজনৈতিক সুযোগসন্ধানীরা বুঝতে পেরেছে যে ধর্ম অবমাননার নাম দিয়ে যা ইচ্ছা তাই করা যায় আর এখান থেকে শুধু রাজনৈতিক ফায়দা নয়-সরাসরি অর্থনৈতিক ফায়দারও সুযোগ রয়েছে। যদি এই সংস্কৃতিকে এইখানেই রুখে দেয়া না যায়, তাহলে দ্রুতই ধর্ম অবমাননা হয়ে পড়বে একটা দুষ্কৃতিকর্মের আর রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধির হাতিয়ার । সেটি ধর্মবিরোধী লোকদের জন্য যতটা না ভয়ংকর, তারচেয়ে বেশি ভয়ংকর ধর্মের পক্ষের লোকদের জন্যে। যদি আমরা এখনই এই ভয়ংকর চিন্তাধারাকে রুখতে না পারি তাহলে সেখান থেকে সূচনা হতে পারে নতুন একটি অতিডান উগ্রপন্থী রাজনীতির-যেটা সারা দেশের সব মানুষের জন্যেই ভয়ংকর।
দিনশেষে আমাদের সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে যাতে করে আমরা কারও গুটি হয়ে না যাই। কেউ যেনো আমাদের বিচার পাবার অধিকার, আমাদের ধর্ম পালনের অধিকার এবং সর্বোপরি আমাদের বেঁচে থাকার অধিকার আমাদের থেকে কেড়ে নিতে না পারে।
উপদেশ কৃতজ্ঞতা
Mashroof Hossain
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ সূচনা অংশের তৃতীয় শ্রেণির কাহনবাদ্যের জন্যে দুঃখিত। মাত্র শেখা শুরু করেছি, এখনো ভালোমত পারিনা।