গত কিছুদিন যাবত রাজনীতি সামান্য কাছে থেকে দেখে আমি যে জিনিসটা হালকা বুঝতে পারলাম সেটা হলো এই বিষয়ে আর কিছু করার আগেই আপনাকে সিদ্ধান্ত নিয়ে হবে যে আপনি আসলে কি হবেন– বুদ্ধিজীবি হবেন, এক্টিভিস্ট হবেন, নাকি রাজনীতিবিদ হবেন। তার ওপরে আপনার ক্রিটিক, কর্মকান্ড সব দাঁড়িয়ে থাকবে।
আপনি যদি নৈতিকভাবে একেবারে অটল এবং দ্বিধাহীন থাকতে চান, তাহলে আপনাকে বুদ্ধিজীবি হইতে হবে। যদি আপনি অনেক মানুষ নিয়ে শক্তিশালী সংগ্রাম করতে চান, তাহলে আপনার কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর যদি আপনি সরাসরি রাজনীতি করতে চান, তাহলে আপনার সিদ্ধান্ত হবে সবচেয়ে কঠিন।
যেমন কালকে রাতে মধ্যরাতের নির্বাচন নিয়ে অনেক হাসাহাসি করা হয়েছে। গতবছরে ভোটের নামে কি হয়েছে আমরা জানি। আমরা অনেকেই নানান ফর্মে এর প্রতিবাদ করেছি। মিছিল করেছি। এটা হলো বুদ্ধিজীবিতা। একক বুদ্ধিজীবিতা, যেখানে আর কারোটা ভাবা লাগেনা।
এবার আসেন নির্বাচনে। ধরেন আপনি কোন বড় দল না। আপনার সাথে লক্ষ মানুষ, বা হাজার হাজার মানুষও নাই যে আপনি এই দিনে নির্বাচন কমিশন ঘেরাও দিয়ে আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বাতিল করাবেন সংস্কারের আগ পর্যন্ত। (সেই শক্তি কোন দলের বাংলাদেশে আছে কিনা কে জানে, থাকলে অনেক কিছুই হয়ে যাইতো) তাহলে আপনি কি করবেন? আপনার তিরিশ জন মানুষকে নিয়ে মিছিল করবেন?
সেগুলা তো এইসব দল কবে থেকেই করে আসতেসে। সেগুলাতে কি মানুষের কাছে কাজের মেসেজটা যায়? দলের শক্তি বাড়ে? দল সম্বন্ধে মানুষ জানে? একটা সত্যিকারের রাজনৈতিক কনটেন্ডার হিসেবে দলের নামটা আসে? সেই জায়গায় না আসা পর্যন্ত একটা দলে আপনি সাংস্কৃতিক রাজনীতিবিদ পাবেন, যেটাও ভালো বিষয়, খারাপ না। তবে ভোটের রাজনীতি করার মতন লোক আপনি পাবেন না। তাদের তখনই পাবেন যখন আপনি সিরিয়াসলি ময়দানের রাজনীতি করার চেষ্টাটা করবেন। নাইলে সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক গ্রুপ হয়ে থাকবেন। সেটাও খারাপ না। কিন্তু ভেবে নেন আপনি সেটা চান, নাকি ক্ষমতায় গিয়ে কাঠামো পরিবর্তন করতে চান?
এবার ধরেন ভোটের রাজনীতি হোক বা সংগ্রামের, আপনি কি একা হাটবেন নাকি অন্যদের নিয়ে হাটবেন? একাও হাটা যায়। আমাদের আরমান ভাই, হানিফ বাংলাদেশি প্রায়ই একা হাটেন। কিন্তু পরে এসে আবার একসাথেও আগান। কারণ একত্র হলে শক্তি বাড়ে। জোট মানেই বহু মতের মানুষের এক লক্ষ্যে একতা। এর চেয়ে সুন্দর আর কি হইতে পারে? যে বহুত্ববাদ আমরা চাই, যে ডাইভার্সিটি অব অপিনিয়ন চাই, সেটার জন্য তো টলারেন্সের একটা চরম উদাহরণ এইটা। এক লক্ষ্যতে একসাথে কাজ, বিপরীত লক্ষ্যে বিপরীত কাজ।
যেহেতু এখন এক লক্ষ্য বেশি, সেহেতু একসাথে কাজ হবে বেশি, স্বাভাবিক না? যত আপনি আপনার ছোট দল নিয়ে আলাদা থাকবেন, তত আপনি পিওর কিন্তু মাইনর বা ইনএফেক্টিভ। যত ছোট দলগুলা একসাথে, তারা হয়তো পিওর না, কিন্তু এফেক্টিভ। এবার ভেবে দেখতে হবে আপনি পবিত্রতা চান, নাকি কাদা গায়ে মেখে কাজ আগাইতে চান। আবার পবিত্র থেকেও কাদা থেকে দূরে একলা কাজ আগাইতে চেষ্টা করতে পারেন, দশক দশক ধরে যেমন করতসেন। কিন্তু ভেবে দেখেন সেটাতে কতটা কাজ হয়। বাটপারি না করে সামান্য ময়লা হইতে পারলে রাজনীতি আগায়, পিছায় না। কিন্তু আপনার সব সহযোদ্ধা যদি একত্রিতাকে বাটপারি ধরে নেয়, নির্বাচনকে আপোষ ধরে নেয়, তাহলে আপনি তাদের সাথে বাটপারি করে এগুলা করতে পারেন না।
কিন্তু বুদ্ধিজীবিতা ছেড়ে একটু সংঘর্ষের রাজনীতি করতে এইসব ঐক্য, জোট, নির্বাচনে যাওয়া অনেক হয়েছে অতীতে। সেনাশাসনের অধীনে শাসককে, তার আমলাতন্ত্রকে, নির্বাচন ব্যবস্থাকে অস্বীকার করতে করতে এর মাঝেও সব উল্টায়ে ফেলার প্রত্যয়ে নির্বাচন করেছেন শেখ মুজিব সহ অনেকে,এবং পেরেও ফেলেছিলেন মুজিব। এরশাদের বিরুদ্ধে একত্রে আন্দোলন করেছে লীগ, জামাত, বিএনপি। সেই এরশাদের পতন ঘটায়ে এখনও তার দলের সাথে জোটে আছে আওয়ামী লীগ। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদগুলো বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামের অনন্য উপাদান।
তাই বলে কি ঐক্যে যাওয়া, নির্বাচনে যাওয়াটা নির্দিষ্ট কোন দিক থেকে হাস্যকর না? বিশেষত যখন এই একই মানুষগুলো এইসব আপোষ ধরণের ব্যাপার নিয়ে হাসাহাসি করে, নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে, ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে?
অবশ্যই। তবে শুধু সেই হাস্যরসের আনন্দ পাইতে গেলে একক বুদ্ধিজীবিতা করা বেটার, এবং সেটারও দরকার আছে। তবে রাজনীতিটা করতে গেলে কিছু হাসাহাসি সহ্য করা ছাড়া উপায় নাই। নাহলে সংগঠন বাড়বে না, সংগ্রাম শক্তিশালী হবেনা।
হ্যাঁ আমি সিস্টেমের ভেতরে ঢুকে সিস্টেম চেইঞ্জের কথাই বলতেসি। কিন্তু যদি আপনার পাওয়ার কেবল খোলা আছে বলে মনে না হয়, যদি আপনার মনে হয় যে আপনি ট্রাকের ওপরে উঠে ট্রাক ঠেলতেসেন না, তাহলে আপনার এইটুকুই করতে হবে। প্রক্রিয়ার ভেতর থেকে সব উল্টে দেয়ার সামান্যতম উপায় কাজে লাগাতে হবে। বাইরের কাজ তো চলবেই সাথে সাথে, তবে ভেতরেরটাও লাগবে।
সে আমার উপায় নিয়ে আপনি হাসবেন, আপনার উপায় নিয়ে আমি হাসবো ঠিক আছে। কিন্তু কোন উপায়টা সবচেয়ে সকলের ভালোর জন্য কাজে দেবে সেটা বের করাটা জরুরি।
অতীতে অনেক এরকম কঠিন সিদ্ধান্ত আমাদের রাজনৈতিকরা নিতে পেরেছিলেন বলে অনেক কিছুই কাজ করেছে। তারা যেমন করেছেন, আমরা এখন তেমন করতে পারিনা, দ্বিধাবোধ করি। সেই দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারলে হয়তো আমাদের রাজনীতিটা আগাবে।
দেখা যাক।
এবার শুরু করেন আমাকে পঁচানো।