নব্য সাংবাদিকতার ঘোরতর সংকট

দেখলেন কি সুন্দর পোস্টের ভেতরে হেডলাইনও বদলায়ে দেয়া যায়? সংবাদ আরো কতো রঙ বদলায়, তারই এক প্রলেপ আলোচনা করবো। ও হ্যাঁ, এটা আসলে সু চিকে নিয়ে কোন খবরই না, এটা ক্লিকবেইট তাড়িত নিউজ নির্মাণের বিপদ সংক্রান্ত একটা লেখা।

প্রেক্ষাপট এই–অং সান সু চির ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে গমনের সময়ে বাংলাদেশের পত্রিকাগুলো “হেগে গেছেন” “হেগে এসেছেন” “হেগে পৌঁছালেন” ইত্যাদি যেসব হেডলাইন করছেন, তা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই মশকরা করে আসছি। এই হেডলাইনটাও সেই মশকরার অংশ, এর সাথে সত্যিকারের কোন নিউজের আগামাথা নাই। এমনকি ফিচারড ছবিটাও সমসাময়িক কিছু না। এই শয়তানিটা আমি জেনে শুনে করলাম। করার পেছনে আমার একটা বৃহত্তর পয়েন্ট আছে।

হেগ সংক্রান্ত সিরিজ জোক গুলা করে সাংবাদিকতার একটা সংকট দেখাইতে চেষ্টা করসিলাম, যেটা হয়তো ভালোমতন ফুটে ওঠেনাই। তাই ভেঙ্গে বলবো আজকে। 

এই যে সু চি হেগ শহরে গেলো, বা গাম্বিয়ার প্রতিনিধিরা গেলো, বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা গেলো, এরা কিন্তু সাইট সিয়িং করতে যায়নাই। শহরের সফরেও যায়নাই। তাহলে শহরের নাম কেন আসবে? তারা গিয়েছেন আইসিজেতে, ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিসে। বললেই হয় আইসিজেতে যাচ্ছেন সু চি। ক্ষমতা বাচাতে হেগে যাচ্ছেন না বলে আইসিজেতে যাচ্ছেন বললে হইতো না?

কেউ যদি এখন ইউএন-এ একটা ভাষণ দিতে যায়, তাইলে কি নিউজ হইতো যে সে নিউ ইয়র্কে গেছে, নাকি বলা হইতো জাতিসংঘে গেছে? যেহেতু হেগ নিয়ে একটা ক্যাচাল লাগাতে পারে, তাহলে সহজ হইতোনা আইসিজে বললে?

হ্যাঁ, মাঝে মাঝে হেডলাইনে ওয়ার্ড কাউন্টের একটা সমস্যা থাকে। তো হেগ আর আইসিজের মাঝে মাত্র এক দুই অক্ষরের ফারাক। চাইলেই হেগেমেগে লেখাটা এড়ানো যায়।  

কিন্তু করা হয়নাই। কেনো? কারণ হয় মনের ভুল, যেটা সম্ভাবনা কম কারণ বারবার করা হইসে এবং আমি ছাড়াও বহু মানুষ পচাইসে। আরেকটা কারণ হয় ক্লিকবেইট দিয়ে পয়সা কামানো। এটা হইলো অনলাইন বা নিউ মিডিয়া জার্নালিজমের সংকট। ক্যাচি হেডলাইন দেয়া লাগে, ছবি দেয়া লাগে, সাবহেড দেয়া লাগে। 

সেগুলা দিতে দিতে মাঝে মাঝে দেখা যায় হেডলাইনের মাঝে সংবাদের আগামাথাই কিছু নাই। মূল আর্টকেলে বলা এক কথা আর হেডলাইন চকচকে বানাইতে দিসে আরেক। হেগ-নিয়ে যেসব সংবাদ বানানো হইসে, সেগুলাতেও এই ঝামেলা হইসে। 

এই “হেগে এসেছেন” নিয়ে কৌতুকটা বহু পুরানো এবং এর আগেও এমন হেডলাইন ভুলে বা জেনে বহুবার করা হইসে। কিন্তু তখনও পত্রিকা বিক্রির একটা ধান্দা ছিলো। ক্যাচি হেডলাইন দেখলে মানুষ পত্রিকা হাতে নিবে, মুচকি হাসবে, এটা সারাজীবনই ছিলো। কিন্তু তবু নিউজপেপার বা ম্যাগাজিন যখন একটা আস্ত পাবলিকেশন হিসেবে বিক্রি হতো, তখন মানুষ আস্ত পাবলিকেশনটা কিনতো। পাবলিকেশনটার একটা ব্রান্ড ভ্যালু তৈরি হইতো। 

আগে মানুষ নিউ ইয়র্ক টাইমস কিনতো, নিউ ইয়র্ক টাইমসের পেপার কাটিং কিনতো না। এখন যেহেতু নিজে পেইজে লাইক দিয়ে রাখার বাইরে মানুষ প্রধানত সংবাদ পড়ে অন্যের শেয়ার দেয়া নিউজ লিংক দিয়ে, সোর্স এখন থোড়াই চোখে পড়ে। চোখে পড়ে থাম্বনেইল, টাইটেল আর স্ট্যান্ডফার্স্ট। সোর্সটা যে কি, সেটা আর কেউ খেয়াল করে দেখেনা। কাজেই যত রঙচঙ্গা থাম্বনেইল আর হেডলাইন দেয়া যায়, হোক সেটা বিকৃত, বালখিল্য বা সোজাসাপ্টি ভুল, তত বেশি ক্লিক আর তত বেশি আয়। কাজেই মূলধারা আর বিকল্প, দুই মিডিয়াই ছুটছে ক্লিকবেইটের পেছনে। এইযে আপনি এই লেখাটা পড়লেন, সেটাও সম্ভবত পড়লেন হেডলাইন, থাম্বনেইল দেখে আপনার চোখ আটকাইসে, স্ক্রলিং থামসে দেখে। নাইলে যদি আমি সত্যিকারের টপিকটা হেডলাইন দিতাম, ধরেন “নব্য সাংবাদিকতার সংকট”, তখন আপনি পুরা আর্টিকেল পরা দূরে থাক, এক্সার্পটটাই হয়তো রিড মোর দিয়া পড়তেন না।

এই ক্লিকবেইটগিরিটা সংবাদের পুরা ধরণটাকে বিকৃত করে দিচ্ছে। ক্লিক বেশি পড়বে এরকম টুকরা নিউজ বেশি হচ্ছে ক্লিক কম পড়বে এরকম ইন ডেপথ লংফর্মের থেকে। আগে যেহেতু মানুষ পুরো সংবাদপত্র একসাথে কিনতো, সেহেতু এই সমস্যা লাগার সুযোগ কম ছিলো কারণ দশ টাকার একটা পেপারের কতো টাকা এক একটা সেকশনে ব্যয় করা হবে, সেটা সম্পাদক ঠিক করতে পারতো। তাই সংবাদের মান রক্ষার্থে যেটা একটু কম মানুষ পড়বে, কিন্তু যেটাতে বেশি জিনিস জানা যাবে এমন সংবাদও ফান্ডিং পাইতো। ইনভেস্টিগেটিভ, লংফর্ম, এনালাইসিস–এইসবে টাকাপয়সা আসতো।

কিন্তু এখন যেহেতু জাস্ট হেডলাইন, ছবি, স্ট্যান্ডফার্স্ট দেখে মানুষ ক্লিক মারে আর ক্লিকে ক্লিকে টাকা, তাই ভেতরে আসলে দেড়শো শব্দ, তিনশ শব্দ, না হাজার দুই হাজার শব্দ সেটা আর কারো জানা লাগেনা। সেই দুই তিনশ শব্দের মানও ভালো হবার দরকার নাই।

কারণ মানুষ তো আর্টিকেল না পড়েই শুধু হেডলাইন দেখেই শেয়ার দিবে, যে কারণে ভুয়া খবরো এতো বেশি ছড়ায়, কারণ কেউ তলায়ে দেখে না। এইজন্য দেখা যাক দেশের প্রান্তিক অঞ্চলের শোষণের খবর পেপারে আসেনা, কিন্তু দূরদেশের কোন লোক পাদ মেরে মশা মারতে পারে, সেই খবরটা আসে। এবং পরে আবার দেখা যাক সেই খবরটাও ভুয়া, ক্লিক কামানোর ধান্দায় দেখেও নেয়া হয়নাই যে খবরটার সোর্স হলো একটা স্যাটায়ার ওয়েবসাইট। 

এই কারণে সংবাদের এমন অবস্থা হইসে যে মূল মিডিয়াকে সস্তা পোর্টাল ধরণের সংবাদ করতে হচ্ছে। পোর্টালগুলার সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ভালো মিডিয়াগুলাকেও ঘন্টায় শখানেক সংবাদও করা লাগে। এতো সংবাদ কই পাবে মানুষ? এতো কম সময়ের মধ্যে গভীরভাবে সংবাদ লিখবে কোথা থেকে? প্রত্যন্ত অঞ্চলের জটিল সমস্যা সে কেমন করে কাভার করবে? তার চেয়ে বরং সস্তা সাংবাদিকতা বেশি খাপে খাপ। এটা তার দোষ না, এটা তার টিকে থাকার একমাত্র উপায়।

এমনকি ভালো খবরেরো বাজে প্রেজেন্টেশন করা হচ্ছে। মিথ্যা হেডলাইন দিয়ে লাস্টে প্রশ্নবোধক দিয়ে দিতে হচ্ছে যাতে করে মানুষ পুরা কনটেন্ট দেখে সেরে পরে আবিস্কার করতে পারে যে অরিজিনাল হেডলাইনটা যে ভুয়া সেটা প্রমাণ করাই প্রতিবেদনের মূল প্রতিপাদ্য। বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে গিয়ে এ কি বললেন ভিপি নূর (দেখুন ভিডিওসহ) শিরোনামের ভিডিও দেখলে দেখা যাবে উনি কিছুই বলেননাই তেমন। বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা হয়তো জানিয়েছেন।

আসলে সবাই জানে তো যে শেষমেশ অধিকাংশ মানুষ পুরাটা পড়বেনা আর হেডলাইন দেখেই শেয়ার মারবে। কাজেই ভুয়া নিউজ ছড়াতেই থাকবে, সংবাদের মান কমতেই থাকবে আর ভালো কাজের কদর কমতেই থাকবে। আর ক্লিকবেইটের উপর বেঁচে থাকা এই ফেসবুক-টুইটারের বিজ্ঞাপনকেন্দ্রিক এলগরিদম যে বাবল তৈরি করে, সেটা কেবল ভুয়া নিউজ ছড়ানোর কারণ হয়ে দাঁড়ায় না, বরং ভুয়া নিউজ উৎপাদনের সূতিকাগার হিসেবেও কাজ করে। আর সেই ভুয়াগিরির সাথে তাল মেলাতে ভালো সংবাদমাধ্যমেও ভুয়া ভুয়া গন্ধ এনে সংবাদ বানাতে হচ্ছে।

এলডাস হাক্সলির ডিস্টোপিয়ায় মানুষ তথ্যবন্যায় এমনভাবে ভেসে যাচ্ছে যে এর মাঝে ভালো কাজকেও শয়তানি করে ক্লিকবেইট বানাতে হচ্ছে। আমি নিজেও তো এই লেখার একটা ক্লিকবেইট টাইটেল দিলাম, এবং প্রায়ই দেই। এই আর্টিকেলের পয়েন্টটা প্রমাণ করার জন্যেই একেবারে আগামাথাবিহীন একটা টাইটেল, ছবি দিসি, কিন্তু এরচেয়ে অনেক সূক্ষ্ম ক্লিকবেইটগিরি করি প্রায়ই। কারণ মানুষের মনোযোগের জানালা এতো ছোট হয়েছে যে দুই সেকেন্ডে চোখ ধরতে পারলে কনটেন্টের ভ্যালু আছে, নাইলে নাই।

এই দুই সেকেন্ডের মাঝে আমরা কিভাবে কাজের কাজ বের করে ফেলবো, সেটাই একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ।

অনুপম দেবাশীষ রায় মুক্তিফোরামের এর একজন সম্পাদক

3 thoughts on “নব্য সাংবাদিকতার ঘোরতর সংকট”

  1. দারুন লেখনী দাদা।নিউজসাইট গুলো কিভাবে কাজ করে ধারণা পাওয়া গেলো।

    Reply
  2. ”শেষমেশ অধিকাংশ মানুষ পুরাটা পড়বেনা আর হেডলাইন দেখেই শেয়ার মারবে। কাজেই ভুয়া নিউজ ছড়াতেই থাকবে”- শুধু হেডলাইন দেখলে আর শেয়ার দিলে তো পয়সা পাবে না। ক্লিক করতে হবে। ক্লিক তো করছে না বেশিরভাগই। তাহলে তো ক্লিকবেইট কাজ করছে না, তাই না?
    আর সুচি হেগ শহরে গেছেন, এটাও তো ভুয়া নিউজ না।

    Reply

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.