ক্ষমতাসীন দলের উদ্যোগে এই পতাকাটি স্থাপন করা হয় থ্যালেস এলেনিয়া কম্পানির তৈরি করা স্যাটেলাইটের মাথায় এবং ছুঁড়ে মারা হয় স্পেসএক্স কম্পানির তত্ত্বাবধানে। সম্পূর্ণ প্রকল্পে বাংলাদেশ ছিলো দারুণ উদ্যমী এক স্পন্সর। ঠিক যেমন মিডলাইফ ক্রাইসিসে ভোগা কোটিপতিরা স্ট্যাটাস সিম্বল হিসেবে ল্যাম্বরগিনি গাড়ি কেনে-ঠিক তেমনি আমরা দুইটি ব্র্যান্ডের কম্পানির কাছে থেকে স্যাটেলাইট কিনে এনেছি। পৃথিবীকে দেখিয়ে দিয়েছি যে আমরা তলাবিহীন ঝুড়ি নই-সাতান্নতম দেশ হিসেবে আমরা এই অভিজাত স্যাটেলাইট ওনার’স ক্লাবের অংশ হতে পেরেছি। আগে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের আকর্ষণিয়া দেশেরা আমাদের পাত্তা দিতোনা-পার্টনারশীপে আসতোনা-এইড পাঠাইতোনা। এখন আমরা তাদেরকে বলতে পারবো, হেই গার্ল-আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখো–ওই যে তারাটা, তার আশেপাশেই আমাদের তারানা হালিম আপা স্যাটেলাইট ওড়াচ্ছেন।
কেবলমাত্র তাই নয়-এই স্যাটেলাইট বানাতে আমাদের নিজস্ব টাকাও খরচ করতে হয়নাই। ঠিক যেমন মধ্যবয়েসী লক্ষপতিরা কোটিপতি হবার ভাব ধরতে ফাইনান্সিং করে দামি গাড়ি কেনে, তেমনি আমারাও ফাইনান্সিং করিয়েছি এইএসবিসি ব্যাংকের থেকে ১৮৮ মিলিয়ন ডলার লোন করে। (১) যখন বৈদেশিক ঋণে আমাদের জাতীয় বাজেট জর্জরিত তখন আরো বিশাল অংকের এই ঋণ নেয়া আকর্ষণিয়া দেশেদের কাছে আমাদের দারুণ পরাক্রমশীল বিচি-অর্থাৎ উন্নয়নের বীজকে দেখিয়ে দেয়া হলো।
আর এই পয়সা আমরা ফেরত দিয়ে দেবো কয়দিনের মধ্যেই, কারণ চল্লিশটা ট্রান্সপন্ডারের মাঝে বিশটা দেশে আর বিশটা বিদেশে ভাড়া দিয়ে আমাদের আয় হবে রমরমা। দেশের ভেতরের বাইরের যতো চ্যানেল আছে, তারা সবাই তাদের বর্তমান ভাড়ার ব্যবস্থা ছেড়ে দিয়ে আমাদের স্যাটেলাইট থেকে ভাড়া নেবে-কারণ অন্যান্য স্যাটেলাইটের তো চেতনা নাই! যদিও একাত্তর টিভির ত্যাঁদড় মোজাম্মেল বাবু বলেছেন যে কু ব্যান্ডের ট্রান্সপন্ডার ব্যবহার তাদের জন্যে একটি সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে আর একটু বৃষ্টি হইলেই সেটা আর ব্যবহারের উপযোগী থাকবে না–দুইটা ছ্যাচা দিলেই কুঁ কুঁ করতে দুনিয়ার সব ব্যান্ডেই চ্যানেল চালানো শুরু করবে। ইন্ডিয়া আর চায়নার মিলায়া নাহয় মহাকাশে এরই মাঝে ব্যবহারোপযোগী আর সুলভ মূল্যের ৩১২ টা স্যাটেলাইট আছে-কিন্তু তাগোর কোনটার উপর জয় বাংলা লেখা আছে? দেশে বইসা চ্যানেল চালাইবা আর জয় বাংলা প্রিমিয়াম দিবানা–তাই কি হয় ভায়া? কাজেই আমরা নিশ্চিত যে দেশের প্রতিবছরের যে পনেরো মিলিয়ন টাকা ভাড়াবাবদ খরচ হয় সেইটা এখন বিদেশের কম্পানিতে না গিয়ে দেশের সরকারের কাছে আসবে (না আসলে ঘাড় ধইরা আসবে!) আর বাকি বিশটা বিদেশে ভাড়া দিয়ে আমরা আরো পয়সা তুইলা আনতে পারবো। যেহেতু আমরা বিপুল দেশপ্রেম নিয়ে মহাকাশে উঠেছি-সেহেতু ব্যবসায়িক হিসেব ভুলেই সকলে কাধে কাধ মিলিয়ে আমাদের কাছ থেকেই ভাড়া নেবে!
আর সবকিছু তো ভাই টাকার খেলা না। যারা শুধু টাকা টাকা করে আর গরীবের ভ্যাটের পয়সায় পতাকা উড়ানো নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে–জেনে নেবেন যে তারা জানেনা যে গরীব দুইটা পয়সা খরচ করেও মহাকাশের বুকে বাংলাদেশের পতাকা দেখতে রাজি আছে। যদি আমরা খরচ করা পয়সা তুলে নাও আনতে পারি-যদি আমাদের লোনের ইন্টারেস্ট ফেরত দেয়ার জন্যে ইম্পোর্ট ডিউটি বাড়ায়ে চালের দাম ৭০ টাকা কেজিতেও বেচা লাগে, যদি আমাদের ভ্যাটের রেট একটু বাড়ায়েও দেয়া লাগে–তাও আমরা করতে রাজি আছি। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের নাম গর্ব করে বলার খাতিরে আমরা সব ধরণের আত্মত্যাগ করতে প্রস্তুত। একাত্তরে তিরিশ লক্ষ মানুষ জীবন দিতে পারসে–আমরা একটু ট্যাক্স দিতে পারবোনা?
প্রয়োজনে গণোভোট করে দেখেন–দেশের মানুষ স্বেচ্ছায় নিজেদের টাকা বের করে দেবে আকাশের বুকে লাল সবুজের পতাকা দেখতে। সেইখান থেকে টাকা পয়সা আয় হইলো কিনা–ইন্টারনেট ভালো হইলো কিনা–তাতে কারো আসে যায়না। এমনই আমাদের দেশপ্রেম যে যদি পারতাম তাইলে জাতীয় স্মৃতিসৌধটার আরেক কপি রকেটে কইরা মহাকাশে বসায়া আসতাম। পৃথিবীর মানুষ দেখুন-বাংলাদেশীরাও পারে!
বাংলাদেশীরাও খরচ করতে পারে–বাংলাদেশীরাও লোন নিতে পারে–বাংলাদেশীরাও সাহস করতে পারে!
——–
নিতান্ত বিছিন্ন খবরঃ অর্থের অভাবে বন্ধ হতে বসেছে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে বাংলাদেশে ফিরে আসা বিজ্ঞানী ডক্টর মোবারক আহমেদ খানের পাট থেকে পলিথিনের বিকল্প প্রস্তুত করবার প্রকল্প। (অবশ্যই আমি দাবি করছিনা যে বাংলাদেশের মহাকাশে পতাকা না পাঠায়ে দেশের কম্পারেটিভ এডভান্টেজ পাটশিল্পের আধুনিকায়নের গবেষণায় মনোযোগ দেয়া উচিত। সাদাসাহেব কইসে আকাশে পতাকা পাঠাইলে উন্নত দেশ হয়–কাজেই আকাশে পতাকা পাঠানোই আমাদের কর্তব্য)
দ্বিতীয় বিচ্ছিন্ন খবরঃ আইনী জটিলতায় কিছুদিন আগে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন স্থগিত করেছিলো হাইকোর্ট। নিন্দুকেরা বলেছিলেন যে আওয়ামী লীগ নাকি জরিপ করে হেরে যাবার শংকা দেখছিলো।
স্যাটেলাইট ওড়ানোর খবর পাবার পরে সেই নির্বাচনের তারিখ দেয়ার তোড়জোড় শুরু হয়েছে।
(অবশ্যই আমি দাবি করছিনা যে স্যাটেলাইট পাঠানোর এই পুরো ব্যাপারটি অনিশ্চিত অর্থনৈতিক বিনিয়োগ কিন্তু সুনিশ্চিত রাজনৈতিক বিনিয়োগ। অবশ্যই আমি বলছিনা যে এই পুরো ব্যাপারটিই করের পয়সায় নির্বাচনী প্রচারণার নামান্তর। এমন কথা আমি ভাবতেই পারিনা।
একজন দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী হিসেবে মহাকাশে দেশের পতাকা দেখে আমিও গর্বিত। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু–বাংলাদেশ দীর্ঘজীবি হোক!)