বাঙালি নাকি খুব হুজুগে–“প্রগতিশীল”দের বাইরে কারো কোন যুক্তি নাই। বানোয়াট জিনিস শেয়ার করে, ভুলভাল কথা বলে, গুজবে বিশ্বাস করে, গালাগালি করে, নারীবিদ্বেষী কথা বলে, হিন্দুবিদ্বেষী কথা বলে আরো বহুত খারাপ কাজ করে বেড়ায়। ধর্ষণ নিয়ে সে ভিক্টিমকে ব্লেইম করে, সেটাকে টানতে টানতে নারীর স্বাধীনতা হরণ করে ফেলার কথা বলে ফেলে। এরা সব, দেয়ারফোর, পটেনশিয়াল রেপিস্ট এবং ইত্যাদি ইত্যাদি।
আচ্ছা, একটু পরে ফেরত আসি। মাঝখানে একটু নিজের গল্প বলে নেই।
ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন আমেরিকার রাজনীতিতে উঠে আসতেসে তখন আমেরিকার সমাজে আমি বসবাস করতাম এবং রাজনীতিবিদ্যার ছাত্র, ওয়াশিংটন ডিসির বাসিন্দা এবং রাজনৈতিক পংটা হবার কারণে বিভিন্ন দল ও দলীয় সমর্থকদের সাথে ঘনিষ্ঠ হোক, অঘনিষ্ঠ হোক–এক ধরণের যোগাযোগ ছিলো। সেখানে আমি চোখের সামনে এস্ট্যাবলিশমেন্টের ব্যর্থতা দেখেছি, আর দেখেছি বড় দুই পার্টি কেমন করে মানুষের কথা ভুলে গিয়ে আকাশে উড়ে বেড়িয়েছে।
ডিসির পাশে আলেক্সান্দ্রিয়া একটু শুনশান। সেখানে আমার এক বন্ধু থাকতো, স্কুটারের মেকানিক। একদিন সে কালিঝুলি মাথা অবস্থা কি একটা স্ক্রু টাইট দিতে দিতে আমাকে বললো, ট্রাম্প সাহেব প্রেসিডেন্ট হয়ে দেশ ঠিক করে ফেলবে।
তখনো অনেক আগের কথা। ট্রাম্প তখন প্রাইমারি জিতে যাবে, এমন ধারণা কোন পন্ডিত করা কি–সে যে হিসেবে আসবে সেটাও কেউ ভাবেনাই। আমি তো অবশ্যই ভাবিনাই। আমি দেশের থেকে যাবার আগেই হিলারি ক্লিনটনের ক্যাম্পেইনে সাইন আপ করে রাখসিলাম, আর সেই সময়টাতে স্কুটারে বার্নি স্যান্ডার্সের স্টিকার লাগানো ছিলো। কিন্তু ট্রাম্প তো একটা ক্লাউন। ওরে কেউ গুনবে কেন?
কিন্তু মানুষ গুনেছিলো। আমার স্কুটার মেকানিক বন্ধু গুনেছিলো। কেন? কারণ আমার বন্ধু বলতো যে ওবামা এমন ট্যাক্স বাড়ানো বাড়াইসে যে তার ট্রাকের ব্যবসা সে আর করতে পারতেসে না, স্কুটার মেকানিক হওয়া লাগতেসে। সে আমাকে আরও কি কি জানি রেগুলেশনের কথা বললো যার কারণে সে ট্রাকের ব্যবসা করতে পারেনাই। সেজন্য সে লিবারালদের উপরে বিরক্ত। এস্ট্যাবলিশমেন্টের সবাই পচে গেছে। এরা মেক্সিকানদের সিটিজেনশিপ দিতে চায় ভোটব্যাংকের জন্য, কিন্তু যারা দেশের ভেতরে থাকা সিটিজেন, তাদের খোজখবর রাখে না। গ্রামের সাদা গরীবের কথা তারা খেয়াল রাখেনা। মধ্য আমেরিকার থেকে উড়ে উড়ে পূর্ব তীর থেকে পশ্চিম তীরে যায়।
ট্রাম্প কি এদের সমস্যা আসলে সমাধান করতে পারসিলো? সম্ভবত পারেনাই। আমি এতো কাছে থেকে আমেরিকান রাজনীতি ফলো করা ছেড়ে দিসি বেশ কিছুদিন। তবে স্পষ্ট ব্যাপারটা এই যে তারা তাকে সমর্থন করসে কারণ রুলিং এস্ট্যাবলিশমেন্ট (যারা দুইটা আলাদা মার্কা ব্যবহার করে থাকে) তাদেরকে ভুলে গেছে, তাদের কাছে পৌছাইতে পারেনাই। ওবামা এতো শিক্ষিত, কমিউনিটি অর্গানাইজিং এ দিক্ষিত হয়েও পারেননাই কোন কারণে–আর হিলারি ক্লিনটন তো মাশাল্লাহ ট্রাম্পের সাপোর্টারদের একাংশকে বাস্কেট অফ ডিপ্লোরেবলসই বলে দিসিলেন।
তাইলে আপনি চিন্তা করেন, কারো মগজে যদি আমি ঘৃণিত হই প্রথমেই, আমার মগজ তাকে নিবে কেন? জগতে পটেনশিয়াল রেপিস্ট না কে? কারো মাত্রা বেশি, কারো কম–আর সেটা কেবল চলন-বলনে বুঝে ফেলা যায় না। কাপড়ো সে পাতা নেহি চালতা হ্যায়। ক্রিমিনোলজি-সোশ্যলজি এতো সস্তা না। আমিও তো পটেনশিয়াল রেপিস্ট। আমি বাংলাদেশের সমাজে বড়ো হওয়া একজন পুরুষ। যেকোন মুহুর্তে আমি রেইপ করতেই পারি অন্য যে কারুর মতন। কিন্তু আমি একটাও “পচা” কমেন্ট করসি, লেখা লিখসি কোত্থাও দেখাইতে পারবেন?
ইভেন আমি যদি অপরাধীও হই, তাইলে তো সত্যিকারের প্রগতিশীল মানবিক রাষ্ট্রের কাজ আমাকে পানিশ করা না, বরং শিক্ষা দেয়া। একটা মানবিক রাষ্ট্রে কারাগার একটা দন্ডাগার নয়, একটা শোধনাকার–ডিপার্টমেন্ট অফ “কারেকশনস” এর অধীনে থাকে। সেটার কাজ ক্রিমিনাল জাস্টিস–পানিশমেন্ট না। জাস্টিস কথাটা এক থ্যাবড়া শাস্তির চেয়ে কঠিন একটা শব্দ। আসেন নাইলে প্রতিহিংসা দিয়েই চিন্তা করি–ফাঁসি দিলে তো শালা মইরাই গেলো, সে সমাজের যে ক্ষতি করসে–সেটা কি খাইটা পোষাইলো? তারে বরং এমনে রাখা উচিত যাতে আমার বেনেফিট হয়। মারলে তো হুদাই জল্লাদের বেতনে আমার ট্যাক্সের টাকা নষ্ট।
ফাঁসি মানেই যে জাস্টিস না, এই কথাটা আমাদের কিশোরেরা বুঝে ফেলেছে। তাদের সহপাঠী মারা যাবার পরেও চোখে পানি নিয়ে তারা “উই ওয়ান্ট জাস্টিস” বলতে পেরেছে আর আমরা বুইড়া বলদেরা এখনো “ফাঁসি চাই”তে ক্যাসেট টেপ আটকায়ে বসে আছে। মেরে ফেললে দুনিয়া শুধরায়ে যায়? ফাঁসি দিয়ে অপরাধ কমেনা এটা পৃথিবির অতিসংখ্যাগরিষ্ঠ গবেষক দেখাইসেন।
আচ্ছা দাও দিয়েনগা ফাঁসি এতো শখ হইলে, গেলো নাইলে একজন দুইজনের জান ভুলে। বিচার বিভাগের কুদরত তো অপ্রশ্নবিদ্ধ (প্রশ্নবিদ্ধ করলে আমারেই বিদ্ধ করে দিতে পারে আন্ডার দ্য গ্রেট পতাকা অফ “অবমাননা”)। কিন্তু আপনি যদি কথা বলা বন্ধ করে দেন তার সাথে, শুরুই করেন গালি পেড়ে, তাহলে আপনার কথা সে কোন জন্য শুনবে? আপনারে একটা গালি দিয়ে আপনার দিয়ে আগায়ে সে যতই মধুর গান গাক না কেনো, আপনার কিন্তু তারে থাবড়াইতেই মন চাবে। তাইলে আমার কাউরে পটেনশিয়াল রেপিস্ট বলার বা তারে ডিপ্লোরেবল বলা তো আমার সেই কথা বলার সম্ভাবনাকেই নাকচ করে দেয়। তাইলে সেই তকমা লইয়া আমরা কি করিবো?
এই তকমাবাজীর অবশ্যই রাজনীতি আছে।
যে রাষ্ট্রে ভোট আছে, সেখানে যেমন ভোটব্যাংকের রাজনিতি আছে, যে রাষ্ট্রে ভোট নাই সেই রাষ্ট্রে তেমন পাওয়ার ব্যাংকের (লল) রাজনীতি আছে। কিরকম? হিলারী কেন বাস্কেট অফ ডিপ্লোরেবল বলসিলো ট্রাম্পের সমর্থকদের? তার নিজের সমর্থকদের অনেক ভালো ফিল করাইতে যে আহা আমরা বুর্জোয়া লিবারাল–কি আনন্দ আকাশে বাতাসে! একইভাবে এখানে যারা পটেনশিয়াল রেপিস্ট ট্যাগ দেয়, তারাও একটা সমর্থক গোষ্ঠী মেইনটেইন করতেসে যারা এই ভাষাটায় কথা বলে, বলে আরাম পায় যে তার সম্প্রদায়ের বাইরের মানুষ রেইপ করে। তবে আমার দৃঢ় ধারণা যে এই প্রগতিশীল, মুখে নারীবাদী ঘরানার মানুষের মাঝে ধর্ষণ-নিপিড়ন করে বেড়ায় এমন লোকের অভাব নাই। কিন্তু তারা কখনও পটেনশিয়াল রেপিস্ট ট্যাগ খাবেনা, কারণ তারা পলিটিকালি ইনকারেক্ট কথা বলবে না–কিন্তু রেইপ হারামীর বাচ্চা ঠিকই করবে।
পটেনশিয়াল রেপিস্ট কথাটা বলা কি পরিমান ডিফিকাল্ট এটা আমাদের বোঝাটা জরুরি। আমি নিশ্চিত একজন ভালো ক্রিমিনোলজিস্টেরও ফেসবুকের উপর ভিত্তি করে মানুষকে বিচার করে পটেনশিয়াল রেপিস্ট বলতে বুক কাঁপবে। আমার সেন্স বলে যে তিনি এইটা বলতেই পারবেন না তার রিসার্চার হিসেবে ইন্টেগ্রিটি ঠিক রেখে, কারণ আমার সেন্স বলে যে ফেসবুক থেকে মানুষ চেনা অনেক কঠিন।
ফেসবুক এমন একটা প্ল্যাটফর্ম যেখানে কোন মনুষত্ব নাই, শুধু কতকগুনা পণ্য আছে। কেউ জীবনযাত্রাকে বিপণনন করছে, কেই সংবাদকে বিপণন করছে, আমার মতন অনেকে একটা সংগঠনকে, একটা আডিয়াকে প্রচার করছে–আবার অনেকে বিপণন করছে নিজেকে। এখানে যেমন ব্যক্তিক বিপণনের জন্য অনেকে প্রগতিশীল ভেক ধরছেন, অনেকে অনুদার ভেকও ধরছেন–নিজের নিজের পাওয়ার ব্যাংক অনুযায়ী। কাজেই এখানে কেউ লিখলে সেটা বিশ্বাস করে–ভেবে লিখছে, নাকি লাইক পাওয়ার জন্য লিখছে, সেটা বুঝে দরকার।
আর যদি ধরেই নেন যে সে বিশ্বাস করেই লিখছে, তার মানে এই না যে সে এটাকে নিয়ে করে ফেলবে একটা কিছু। আমি একটা বেয়াদবি করবো রিসার্চ ছাড়াই একটা ট্রেন্ড লক্ষ্য করার নাম দিয়ে, সেটা হচ্ছে যে ধর্ষকদের অধিকাংশই দেখা যায় হয় ক্ষমতার দ্বারা আচ্ছাদিত বলে তারা সাহস পান যে এটার থেকে তারা পার পেয়ে যাবেন, অথবা তারা মানসিক সমস্যায় আচ্ছাদিত। আর এই ক্ষমতা-প্রতিপত্তি রাজনৈতিক হইতে পারে, আবার সামাজিকও হইতে পারে। কোন সামাজিক গোষ্ঠী আসলেই ধর্ষণতন্ত্রে বিশ্বাস করে থাকে বলে আপনার মনেই হয়, তাইলে তারে গালি দিয়ে আলাদা করে তো লাভ নাই কোন, তার সাথে ফেসবুকে বাহাস করেও কোন লাভ নাই। ফেসবুকে, স্পেশালি পাবলিক কমেন্টে, মানুষ তর্কটা গুড ফেইথে করে না, কিছু জানার, শিখার জন্য করে না–করে নিজেকে জাহির করার জন্য। আমি নিজে এই জাহিরি করসি, আমি জানি।
কিন্তু একই আলাপ সামনাসামনি দেন, দেখেন তারে বুঝানো যায় কিনা–আপনি ইচ্ছা থাকলেই একরকমের বুঝে আসবেন, বা নিজের ভুল ধরতে পারবেন। আলাপ বলতে আমরা যা বুঝি, ফেসবুক তার যায়গা না। ফেসবুক একটা সোশ্যাল “নেটওয়ার্ক” এইটা সোসাইটি বা তার প্রতিবিম্ব গোছের না। সোসাইটি নিয়ে কাজ করলে সোসাইটিতে যাইতে হবে। ফেসবুকে বসে কমেন্টে গাইল পাড়লে হবে না। ফেসবুক কিছু বাবল পয়দা করতেসে যেটা আমাদের ভুয়া সমাজের একটা আভাস দিয়ে সত্যিকারের সমাজ থেকে আলাদা করে ফেলতেসে। ফেসবুক তাই সামাজিক “যোগাযোগের” মাধ্যম হওয়া দরকার, সমাজের বিকল্প না হয়ে।
সমাজ বদলাইতে গেলে সামাজিক হইতে হবে, আমারও-আপনারও-সবার। ব্যক্তিক চিন্তা করতে হইলে সমাজ আপনি বদলাইতে পারবেন না–সেই ঠ্যাকা আপনের নাই–তবে কমপক্ষে সমাজ বদলাইতে চান, এই ভেক ধইরেন না। প্রগতি আপনি একা চাইতে পারেন ভাই, তবে বামপন্থী বইলেন না। ব্যক্তিক প্রগতিশীলতার মতন বড়ো পুঁজিবাদী প্রোডাকশান আর নাই। আপনি প্রগতি যদি খালি আপনার আর আপনার ভাই বেরাদারদের চান–আবার সমাজের ট্যাক্সের প্রটেকশন নিয়ে, তাইলে আপনি আসলে ক্যাপিটালিস্ট লজিকে বাঁচেন, সেটা মেনে নেন। সমাজ বদলাইতে চাইলে সমাজের ভাষা চিনেন, মানুষ চিনেন–তাদেরকে তফাত করে ফেইলেন না। যদি বেশি উপরে উইঠা যান আপনের সমাজ থেকে, তখন আপনি উপর থেকে একদল খুলির সমুদ্র দেখতে পাইবেন–একটা কার্পেট বা মোজাইক দেখবেন–চেহারার বৈচিত্র আর বুঝে পড়বে না।
তাই বরং আসেন মাটিতে নামি। একটু হাঁটি। দূরে যাই–মানে এটলিস্ট একই শহরের অন্য উপজেলায়। অন্য সম্প্রদায়ে যাই–মানুষের সাথে কথাবার্তা বলি। শিখি, বুঝি–যে আমরা কোন দুনিয়ায় থাকি। গাইলটা একটু পরেও পাড়া যাবে, বন্ধু হবার পর। সেই গাইলে তখন কেউ রেগে যাবেনা, বরং হাসবে উলটা। বরং চলেন সেই গাইলটা পাড়ার যোগ্যতা অর্জন করি।
অনুপম দেবাশীষ রায় মুক্তিফোরামের মুখপত্র সম্পাদক