কোন একটা অদ্ভুত কারণে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষ সারাক্ষণ রাজনীতি নিয়ে কথা বলে। আমরা সংস্কৃতিটার মাঝে বড়ো হয়েছি বলে আমাদের কাছে ব্যপারটা অদ্ভুত লাগে না-কিন্তু ব্যাপারটি সত্যিই অদ্ভুত। ধরেন ঈদের দিন আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে যাওয়া হলো, সেমাই খাওয়া হলো দুপুরের খাওয়া হলো, পোলাও গোশতো শেষ, এখন আয়েশ করে পেট ফুলিয়ে বসার ঘরে বসে সবাই মিলে রাজনীতি নিয়ে অবশ্যই সবাই আলোচনা করতে বসবে। আয়োজন করে বাসার সব ছোট মানুষদের অন্য ঘরে পাঠিয়ে দেয়া হবে আর বসার ঘরের দরজা বা পর্দা টেনে দেয়া হবে-বড়ো মানুষেরা বড়ো মানুষদের কথা বলবেন-তো ফারুক সাহেব, দেশের অবস্থা কি বুঝতেসেন? দুই মহিলা মিলে তো দেশটা ছারখার করে দিলো!
এর মাঝে একজন থাকবেন অফিসে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্যানেলের পদপ্রার্থী, একজন বিএনপি সমর্থক-এখন তার আদর্শ আন্ডারগ্রাউন্ডে আছে, আর আরেকজন সুপ্ত জামাত সিমপ্যাথি বুকে লালন করেন। শুরু হয়ে যাবে আড্ডা, আড্ডার বিষয় হলো রাজনীতি। রাতের বেলা টিভি খুললেই দেখা যাবে বিভিন্ন চ্যানেলে টক শো! সব জায়গায় প্রত্যেকদিনের রাজনীতির কানাকিঞ্চির সব খবর নিয়ে তুমুল বিশ্লেষণ করছেন কিছু মানুষ। ব্যাপারটা আসলেই কিছুটা অদ্ভুত কারণ এতো রাতে যারা টিভি দেখতে এসেছে-ধরে নেয়া যায় তারা ঘুমানোর উদ্দেশ্যেই টিভিসেটের সামনে বসেছে আর টিভি চ্যনেলগুলো হিসেব করে বের করেছে যে রাজনীতি নিয়ে ঝগড়া এই সময়ে টিভি চ্যানেলে ছেড়ে দিলে সবাই মিলে সেটা দেখবে। অর্থাৎ রাজনীতি নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি একটি জাতিকে রাতে ঘুমাতে অথবা ঘুম ফেলে জেগে থাকতে সাহায্য করছে। বিদেশী কোন চ্যানেলে এই সময়ে টিউন করলে দেখা যাবে কোন হাসির সিনেমা বা ভুতের নাটিক বা বড়জোর একটা হালকা সিচুয়েশনাল কমেডি দেখাচ্ছে। অথচ আমরা রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করছি। ব্যাপারটা কিন্তু খুবই ভুতুড়ে!
আমরা যে রাজনীতি নিয়ে অন্য অনেক জাতির চেয়ে অনেক বেশি সচেতন সেটার আরো একটা সত্যিকারের প্রমাণ পাওয়া যায় আমাদের ভোটার টার্নআউটে। বাংলাদেশের শেষ গ্রহণযোগ্য আর সকল দলের অংশগ্রহণের নির্বাচন অর্থাৎ ২০০৮ সালের নির্বাচনে ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের মতে দেশের সাতাশি শতাংশ মানুষ অংশ নিয়েছে যেখানে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে দেশটির কেবলমাত্র বেয়াল্লিশ শতাংশ। অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি মানুষ সেখানে ভোট দেয়ারই প্রয়োজন বোধ করেনি-কারণ তাদের রাজনীতি নিয়ে কিছুই এসে যায়না। ওদের রাজনীতি নিয়ে তেমন কিছু এসে যায়না কারণ কোন দল জিতলো তাদের ওপর ওদের কোন আত্নীয়ের বেঁচে থাকা মরে যাওয়া নির্ধারণ করেনা, ওদের বাবার চাকরি টিকবে নাকি-বা প্রমোশন হবে নাকি এই দুশ্চিন্তা শুরু হয়না এমনকি তারা এখন তাদের পছন্দের পোশাক পরে পছন্দের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যেতে পারবে নাকি সেই স্বাধীনতার কোন পরিবর্তন হয়না-আমাদের হয়। একটি নির্বাচনের ফলাফলে আমাদের জাতীয় জীবনের সব হিসাবকিতাব পালটে যায়। সেইজন্যেই হয়তো যখন কোন একটা অগণতান্ত্রিক সরকারের অধীনেও আমাদের পছন্দের হিসাবকিতাবে সবকিছু চলে তখন আমরা আর নির্বাচন নিয়ে মাথা ঘামাইনা। ঈদের দিন বসার ঘরে বসে সরকারকে গালি দেই কিন্তু নির্বাচন চাইনা-কারণ আমাদের পছন্দের হিসাবকিতাবে সবকিছু চলে।
তবু আমরা বুঝতে পারি কোথাও একটা গভীর সমস্যা রয়ে গেছে, সমাজের সমস্যাগুলো সমাধান হচ্ছেনা । আমরা সরকারকে গালি দেই-আরও ভালো কোন নেতার জন্যে অপেক্ষা করি।
যে আমাদের এখনকার সংসদনেতাদের মতন বজ্জাত হবেনা, ঘুষখোর হবেনা, মাস্তানের সর্দার হবেনা। ঘোড়ার চড়ে তলোয়ার হাতে মেঘের মধ্যে দিয়ে কোন এক সুদর্শন নেতা উড়ে আসবে আর আমাদের জাতিকে তার দুর্দশার থেকে বাচাবে। আমরা সেইজন্যে অপেক্ষা করি। কিন্তু সুদর্শন নেতা কোনদিন আসেনা। কুদর্শন নেতারা তাদের কদাকার মুখ থেকে থুথু ছেটাতে ছেটাতে মিথ্যা কথা বলেন, নোংরা কথা বলেন আর অকারণেই বেশি বেশি কথা বলেন। জনগণের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়না। জনগণের ভাগ্য যেমনটি ছিলো তেমনটিই থাকে। খুব ধীরগতিতে অল্প অল্প করে মানুষ নিজেদের ভাগ্য হয়তো কিছুটা উন্নত করে। চায়ের টঙয়ের লাভ দিয়ে বাজারে একটা ছোট দোকানঘর কেনে। দোকানে রাখে পান সুপারি, চিপস, গরুর দুধের চা, কোল্ড ড্রিংকের একটা ফ্রিজ আর সামনে পাচ ছয়টা টুল। কিন্তু তারপরে একদিন সরকারী দলের গুন্ডারা চাঁদা চাইতে আসে। পুলিশ ডাকলে পুলিশ থানায় নিয়ে চা খাইয়ে ছেড়ে দেয়। আর ভাগ্য খারাপ থাকলে নিজেরাও উলটো টাকা চাইতে আসে। ব্যবসায়ী মানুষ-অনেক তো মালসামান, একটু জনতার মাঝে ছড়িয়ে দিলেই হয়। একত্রিশ শতাংশ কর দিয়ে জনগণ উপভোগ করে দশ শতাংশ বখরা আর পাচ শতাংশ প্রটেকশন মানি দেবার রাষ্ট্রীয় আর রাজনৈতিক বাহিনী।
এই ভয়ংকর সংস্কৃতির মাঝে বড়ো হয়েও কেন জানি আমিও সরকারকে দারুণ বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম। বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম যে এইপিস সরকারটাই খারাপ, অন্য কোন সরকার আসলে-যখন ভালো মানুষরা রাজনীতি করবে, তখন হয়তো অনেক ভালো একটা বাংলাদেশ হবে। তার কারণ আমি দেবতাদের সংস্কৃতিতে বড়ো হয়েছিলাম। আমি বিশ্বাস করতে শিখেছিলাম যে যখন দুর্গতির সময় আসে তখন কোন একজন মানুষ দুর্গতিনাশ করতে দেবতা হয়ে ওঠে। আমি সেই দেবতার জন্যে অপেক্ষা করতাম আর মনে মনে হয়তো সেই দেবতাও হবার চেষ্টা করতাম। কাজেই যখন তন্ময় ভাইয়া আমাকে প্রথম মালয়েশিয়ায় একটা ডিবেট টুর্নামেন্টে যাবার পথে প্রথম বললো, তোকে প্রথমে ভাবতে হবে যে ব্যাপারটাতে সরকারের নাক গলানোর অধিকার আছে কি না-তখন কথাটা পুরোপুরি আমার মাথার উপর ঠোকর খেয়ে ছুটে গেলো। সরকারের কোন একটা ব্যাপারে নাক গলানোর অধিকার থাকে না কেমন করে? সরকার তো সব করতে পারে! সরকার তো দেবতা-তার হাতে সকল ক্ষমতা। ব্যাপারটা আমি কিছুটা বুঝতে পারলাম যখন আমি আমেরিকায় এসে বসবাস করা শুরু করলাম। আমি দেখলাম যে এখানকার মানুষজন সরকারকে পাত্তাই দেয় না। তারাও সরকারকে গালিগালাজ করে কিন্তু কেমন জানি তীব্র একটা সত্যিকারের ঘেন্না নিয়ে গালিগালাজ করে। ব্যাপারটা আসলে আমাদের মতন গালি-দিবো-কিন্তু-সময়-হইলে-ভোটও-দিবো মার্কা আদরমাখা গালি না, ব্যাপারটা সত্যি সত্যি তীব্র রাগ আর ঘেন্নাওয়ালা গালি। ব্যাপারটা আমি ধীরে ধীরে আরেকটু বোঝা শুরু করলাম যখন রিভানা ইকোনমিকস ক্লাস শেষ করে এসে এসে আমার সাথে ওর প্রফেসরকে নিয়ে গল্প করা শুরু করলো-একদিন সে ফিরে এসে বলা শুরু করলো, আমি বোধহয় আমেরিকায় পড়াশুনা করতে এসে ভুল করসি রে! এরা বলে গভমেন্ট নাকি মাফিয়া,সবার থেকে নাকি জোর করে টাকা নিয়ে সবার মতের বিরুদ্ধে টাকা খরচ করে। ব্যাপারটা আমি আরও বেশি বুঝতে পারলাম যখন আমি মাইনাস দশ শীতের মাঝে বাসের জন্য দাঁড়ায়ে থাকার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে একটা স্কুটার কেনার সিদ্ধান্ত নিলাম। আসলে আমার স্কুটার সরকারবিরোধী আমেরিকান ছিলো না, আমার স্কুটারের মেকানিক সরকারবিরোধী আমেরিকান ছিলো। প্রথম যেদিন আমি তার দোকানে গেলাম সে আমাকে বললো-তুমি এই নির্বাচনে কাকে সাপোর্ট করো? বাংলাদেশের লালমার্কা চ্যাতনা তখনও আমার মাথা থেকে বের হয়নাই, কাজেই অবশ্যই আমি বার্নি স্যান্ডার্সকে সাপোর্ট করতাম। আমি যখন বললাম যে আমি বার্নিকে সাপোর্ট করি তখন সে কিছু না বলে একটা মুচকি হাসি দিলো-এরপর আমাকে জিজ্ঞেস করলো বার্নি স্যান্ডার্সের ট্যাক্স পলিসি তুমি জানো? সে যে সব আমেরিকানের ট্যাক্স বাড়ায়ে দেবার পরিকল্পনা করছে সেটা জানো?
আমি আমতা আমতা করছিলাম কারণ আমি আসলে প্রস্তুত ছিলাম না যে একজন স্কুটার মেকানিক আমাকে দুম করে ট্যাক্স পলিসি নিয়ে প্রশ্ন করে বসে থাকবে। ভাগ্য ভালো আমি বার্নি স্যান্ডার্সের ট্যাক্স পলিসিটা জানতাম নাহলে ওই দোকান থেকে বের হয়েই আমার মেজর বদলানো লাগতো। স্কুটার ম্যাকানিক আমাকে বললো, তুমি জানো আমার এক বন্ধু ছিলো ভারমন্টে-তার ছিলো ট্রাকের ব্যবসা। এই স্টেটের জিনিস ওই স্টেটে দিয়ে আসে। তোমার বার্নি সেই ভারমন্টে এমন ট্যাক্স বাড়ানো বাড়াইসে যে আমার বন্ধুর এখন ট্যাক্স দিতে দিতে লেবারদের দেয়ার মতন টাকা নাই। দশটা ট্রাকের মধ্যে নয়টা বিক্রি করে দেয়া লাগসে। এখন সে একা একটা ট্রাক চালায়। আমি তখন মিনমিন করে বলার চেষ্টা করলাম যে দেখো একটু বেশি ট্যাক্স দিলে তোমার হেলথকেয়ারের জন্যে টাকা দেয়া লাগবে না, এডুকেশনের জন্যে টাকা দেয়া লাগবে না। তখন সে বললো, আরে রাখো তোমার হেলথকেয়ার। তোমার বারাক ওবামা আসার আগে আমার জীবনেও হেলথ ইন্স্যুরেন্স লাগেনাই। ও এখন এসে জোর করে করাইসে। জীবনে হাত পা আমার কাটবে একবার, অসুখ হবে একবার। বেশি টাকা লাগলে তখন দরকার হইলে লোন নিয়ে খরচ দিবো-নাইলে টাকা না দিয়া নিজের ইচ্ছায় মরবো-নিজের স্বাধীনতায় মরবো। এখন প্রতিমাসে জোর করে আমার থেকে টাকা নিয়ে যাবে, আমি চাই আর না চাই-আমার কোন অসুখ হোক আর না হোক। আমি কিচ কিচ শব্দ করে বলার চেষ্টা করলাম-দেখো, সোশ্যালিজম কিন্তু ইউরোপের অনেক দেশে কাজ করসে, এখানেও করতে পারে। মেকানিক তখন আমাকে বললো-দিস ইস নট ইউরোপ সান, দিস ইস আমেরিকা। দিস কান্ট্রি ওয়াজ মেড সো দ্যাট উই ডোন্ট হ্যাভ টু পে হাই ট্যাক্সেস। আমি ব্যাপারটা ধরতে পারলাম যখন ওয়াশিংটন ডিসিতে আমেরিকান হিস্টরি মিউজিয়াম দেখতে গেলাম। আসলেই আমেরিকানরা ট্যাক্স দিবেনা বলেই একটা আস্ত দেশ স্বাধীন করে ফেলেছে। ওদের সাংস্কৃতিক, বিপ্লবী বা আবেগিক কোন আদর্শের অনেক আগে চোখের সামনে ছিলো সোজাসাপ্টা একটা অর্থনৈতিক সমস্যা-বৃটিশরা কলোনিগুলোর থেকে সম্পদ চুরি করছিলো স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা দিয়ে আর বেশি বেশি ট্যাক্স নিয়ে গিয়ে। কাজেই আমেরিকানরা এমন একটা রাষ্ট্র সৃষ্টি করলো যেটা তার জনগণ থেকে অর্থ চুরি করে নিয়ে যাবেনা বরং সরকারের একেবারে প্রাথমিক কিছু কাজে সীমিত থাকবে আর জনগণকে তার নিজের অর্থ দিয়ে নিজেদের সামর্থ অনুযায়ী নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে দেবে। তারা যেটা করলো সেটা হচ্ছে তাদের কলোনাইজারদের সমগ্র ব্যবস্থা ছুড়ে ফেলে দিয়ে নতুন একটা ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করলো। এমন একটা ব্যবস্থা যেখানে সরকারের তিনটা শাখা-আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ আর শাসন বিভাগ একটা আরেকটাকে সীমা লঙ্ঘন করার থেকে বিরত রাখবে। আইন বিভাগকে ভেঙ্গে দিতে পারবে শাসন বিভাগ, শাসন বিভাগের তলা থেকে মাটি সরিয়ে নিতে পারবে আইন বিভাগ আর বিচার বিভাগ আইন বিভাগের অথবা শাসন বিভাগের যে কাউকে জেলে ঢুকায়ে বসে থাকতে পারবে। এইযে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে যে আমরা এতো লাফালাফি করি-সেই প্রেসিডেন্ট তার আইন বিভাগের সহায়তা ছাড়া আসলে যে কতোটা সীমাবদ্ধ সেটা দেখলে রীতিমত মায়া হয়!
অথচ একটা প্রচন্ড রাজনীতি সচেতন জাতি হয়েও আমরা এই ধরণের সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। তার অন্যতম কারণ ছিলো এই যে এই ধরণের সিদ্ধান্ত নেবার এখতিয়ার আমাদের বৃটেন থেকে স্বাধীন হবার সময়ে ছিলো না। বৃটেন থেকে স্বাধীন হয়েমাত্রই আমরা চলে গিয়েছি আরেক কলোনাইজার এর কবলে যারা বৃটিশদের রেখে যাওয়া শাসনব্যবস্থা, আমলাতন্ত্র আর প্রশাসনকে খুবই ভালো অস্ত্র হিসেবে গণ্য করেছিলো আর বেশ দক্ষতার সাথে সেই একই অস্ত্র ব্যবহার করে আমাদের বৃটিশদের মতন করে শোষণ করা শুরু করেছিলো। তবে আমরা একসময় টের পেলাম যে এই ব্যাপারটা কখনই কাজে দেবে না-প্রভুর হাতিয়ার কোনদিন প্রভুর প্রাসাদ ভাংতে সক্ষম হবেনা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দিলেন-বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। কিন্তু স্বাধীনতার পরে তিনি ভয়াবহ ভুল যেটি করলেন সেটি হলো ধরে নিলেন যে সাত কোটি মানুষ মুক্তি বলতে আসলে কি বোঝে সেটি তিনি আর তার দলের কিছু হর্তাকর্তা মিলে ঠিক করে ফেলতে পারবেন। সত্তরের দশকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে তীব্র প্রতিদ্বন্দিতার মাঝে বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করলো একটা পিপলস রিপাবলিক হিসাবে-একটি গণপ্রজাতন্ত্র নামে যেটা কিনা একটা খাঁটি সমাজতান্ত্রিক দেশ মার্কা নাম। চারটা মূলনীতির মাঝে একটা মূলনীতির মাঝে একটা মূলনীতি ধরা হলো সমাজতন্ত্র আর তার খুব কোল ঘেঁষে রাখা হলো গণতন্ত্র। নতুন একটা জাতি বুক চিতিয়ে বললো যে তারা গণতন্ত্র আর সমাজতন্ত্রকে একসাথে নিয়ে আগাতে পারে।
ব্যাপারটা সাহসী কারণ সমসাময়িক ইতিহাস প্রমাণ করছিলো যে তথাকথিত সমাজতন্ত্র আর গণতন্ত্র একসাথে টিকে থাকা খুব একটা সম্ভবপর ব্যাপার নয়। কারণ যে ব্যাপারটিকে আমাদের বাংলাদেশি সমাজতন্ত্রীরা কমিউনিজমের বাংলা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন সেটা আসলে কমিউনিজমের ধারেকাছেও কিছু না। সহজ করে বলি-কমিউনিজম বলেছিলো যে ধনীরা এমন একটা সমাজ সৃষ্টি করেছে যেখানে গরীবের টিকে থাকার কোন সুযোগ নেই। ধনীর উচ্ছিষ্ট খেয়ে তার বেঁচে থাকতে হয়। কাজেই এই ব্যবস্থা গুড়িয়ে দিতে হবে। কিন্তু কিছু সুযোগসন্ধানী লোক এখান থেকে অনুসিদ্ধান্ত বের করলো যে কমিউনিজম মানে আসলে ব্যক্তিগত বুর্জোয়ার পতন ঘটিয়ে রাষ্ট্রীয় বুর্জোয়ার উত্থান নিশ্চিত করা। যে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর মাওবাদী চায়নাকে বাংলাদেশী সমাজতন্ত্রীরা কমিউনিস্ট বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলো তারা নিখাদ বিরাট আকারের দুইটা স্বৈরতান্ত্রিক আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র যারা সব ব্যবসার ওপর একটা রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া ব্যবসা বসিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিলো।
অবশ্যই ব্যাপারটা কাজ করেনি কারণ ওইযে- কোটি কোটি মানুষ মুক্তি বলতে কি বোঝে, কম দাম বলতে কি বোঝে, বেশি দাম বলতে কি বোঝে, উন্নয়ন বলতে কি বোঝে, দেশপ্রেম বলতে আর জাতীয়তাবাদ বলতে কি বোঝে সেটা একদল কোট টাই পরা লোকজন ঠিক করে ফেলতে পারেনা। সারা দুনিয়ার সামনে কমিউনিজমের জঙ্গীবাদী একটা ব্যখ্যা দিয়ে সোভিয়েত লাল আমলাতন্ত্র একটা ভয়ংকর কাজ করে ফেললো-মানুষকে একটা ভুল বাম দেখিয়ে দিলো। বিরাট আমলাতন্ত্র আর পরগাছা প্রশাসনের বাম। স্বৈরতন্ত্র আর সিক্রেট পুলিশের বাম। রাষ্ট্রীয় শোষণ আর অত্যাচার নির্যাতনেত বাম। অথচ বামপন্থার জন্ম হয়েছিলো স্বৈরাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থার পতনের জন্যে। ফরাসী বিপ্লবের বাম ছিলো রাজতন্ত্রের পতনের বাম। সত্যিকারের কমিউনিজম মিথ্যাকারের সোশ্যালিজমের মাঝে কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো। আর বাংলাদেশ গ্রহণ করলো সেই সোশ্যালিজমের বঙ্গানুবাদ-সমাজতন্ত্র। কমিউনিজমের কোন জুতসই বাংলা নামও খুজে পাওয়া যায়না কোথাও। সমাজতন্ত্রের ভুল ধারণায় বিরাট একটা শোষণযন্ত্র হাতে নিয়ে একজন অসমসাহসী জাতির পিতাকে নামতে হলো তার যুদ্ধবিদ্ধস্থ দেশের পুনর্গঠনে।
কিন্তু এই সাহস দীর্ঘস্থায়ী হলো না। ইরানে বিপ্লব হলো, মিশর আর সিরিয়া ইসরায়েল আক্রমণ করলো আর ওপেক বললো আমরা আর পশ্চিমের কাছে তেল বেচবো না। কাজেই তেলের দাম লাফ দিয়ে দশগুণ বেড়ে গেলো আর সারা বিশ্বে মোটামুটি একটা অর্থনৈতিক কাঁপাকাপি লেগে গেলো। বাংলাদেশে শুরু হলো দুর্ভিক্ষ। অসম সাহসিকতা বুকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু মহামানব হবার সিদ্ধান্ত নিলেন। গণতন্ত্র নামক মূলনীতির কথা ভুলে তিনি সোভিয়েত স্টাইলে দেশের সব রাজনীতিক দল নিষিদ্ধ করে দিলেন, সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দিলেন আর নিজেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করলেন। ততদিনে তার বানানো রাষ্ট্রীয় সুবিধাভোগী মিলিশিয়া রক্ষীবাহিনী অনেকটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে রীতিমতো সরকারী গুন্ডাপান্ডা হয়ে উঠেছে-মানুষ অতীষ্ট। রক্ষীবাহিনীর পয়সা যোগাতে সেনাবাহিনীর তহবিলে টান পড়লো-সেনাবাহিনী ক্ষুব্ধ। এরপর কালোরাত। কিন্তু কালোরাতের পরে মানুষ সত্যিকারের আনন্দে রাস্তায় মিছিল করা শুরু করলো। অপদেবতার মৃত্যু ঘটেছে। এবার নতুন কেউ আসবে। খুব ভালো কেউ। খুব অসাধারণ কেউ। একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করে বাঙালি ফুলের ওপর পাড়া দিয়ে ভবিষ্যতের মিছিলে সামিল হলো। এরপরে প্রায় চার দশক পার হয়েছে। বাংলাদেশ আর বাংলাদেশীর রাজনীতি নিয়ে কথা বলা কিন্তু এখনো থামেনাই। আমরা এখনো কথা বলছি-এখনও বিতর্ক করছি-কিন্তু অনেকটা ভুল পথে করছি। আমরা এখনও জিজ্ঞেস করি এই সরকার এতো শয়তান কেনো? আমরা জিজ্ঞেস করিনা এই রাষ্ট্র এতো পিশাচ কেনো? আমরা জিজ্ঞেস করি সরকার এখনও আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতি করাতে পারেনাই কেনো, আমরা জিজ্ঞেস করিনা সরকার আমাদের অর্থনীতির উন্নতি করার কে? আমরা জিজ্ঞেস করি সরকার প্রশ্নপত্র ফাঁস আটকাতে পারে না কেনো-আমরা জিজ্ঞেস করিনা সরকারের প্রশ্ন বানানোর দরকারটা কি? এখনও কিন্তু আমরা রাস্তায় পকেটমার ধরলে পুলিশে দেয়না-ধরে গণধোলাই দেই। পকেটমার পুলিশের ভয়ে থাকেনা-মাইরের ভয়ে থাকে। পাঁচশ টাকা দিয়ে পুলিশকে ঠান্ডা করা যায়-কোটি টাকা দিয়েও পাগলা পাবলিককে ঠান্ডা করা যায়না। অধিকাংশ রাস্তায় কোন ট্রাফিক লাইট কাজ করেনা। মানুষ দেখে শুনে গাড়ি চালায় নিজের জানের ভয়ে-আরেকটা গাড়িতে লাগলে মাইর খাবে, সেই ভয়ে। রাস্তায় একটা গ্যাঞ্জাম লাগলে কে যায় তিন বছর ধরে আদালতের ঘানি টানতে? এক মুরুব্বি মাঝখানে এসে মধ্যস্থতা করিয়ে দেয়। যখন ঈদের দিন সব মানুষ একসাথে আনন্দে মেতে ওঠে আর আমি আমার তিনবন্ধুর বাসায় দাওয়াত খেয়ে চতুর্থ বান্ধবীর মায়ের ‘আরেকটু নাও বাবা’-মার্কা চাউনির দিকে অসহায়ের মতো চেয়ে থাকি তখন কার আসে যায় রাষ্ট্রধর্ম কি? মানুষ ঈদের জামা কিনে মার্কেটের পাশে দাঁড়ায়ে থাকা স্কুলের ছেলেপেলের বানানো সংগঠনে পথশিশুদের কাপড় কিনে দেবার জন্য ধরে থাকা বাক্সের টাকা ফেলে কোন জেলজুলুমের ভয় দেখানো ট্যাক্স অফিসারের কথায় নয় মনের আবেগের থেকে। ছেলেমেয়েগুলো বাসায় ভিডিওগেম না খেলে রাস্তায় নেমে সংগঠন করে ভালো স্কুলে চান্স পাওয়ার লোভে না-সত্যিকারে তারা পথশিশুদের জন্য কিছু করতে চায় বলে।
তাহলে আমার প্রশ্ন হলো-আমাদের সরকারের দরকারটা কি? ক্ষমতার ছায়ায় গুন্ডাপান্ডা পুষে আমার ব্যবসার লাভ চুরি করে নেবার জন্য নাকি সারাসন্ধ্যা পড়িয়ে জমানো টিউশিনির টাকা রাত বারোটায় রাজলক্ষ্মী পুলিশ ফাড়ির সামনে ছুরি দেখিয়ে কেড়ে নেবার জন্য? নাকি বছর বছর জুড়ে ছেলেপেলের পড়ালেখার কষ্ট প্রশাসনিক দূর্বলতার একটা ফাঁকাগলে নষ্ট হয়ে যেতে দেবার জন্যে? নাকি একের পর এক হামলা মামলা ফাইল চাপা হয়ে পড়ে হারিয়ে যাবার জন্যে? নাকি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সর্বগ্রাসী ক্ষমতার আচ্ছাদনে জঙ্গীগোষ্ঠী, পেশাদার গুন্ডাগোষ্ঠী আর অপরাধীগোষ্ঠী গড়ে তোলবার জন্যে? আমাদের সরকার আমাদের জীবনে এতো বড় প্রভাব ধরে রাখতে পারে কারণ আমরা আমাদের সরকারকে এতো বড় একটা প্রভাব ধরে রাখতে দেই। আমরা কখনও আমাদের সরকারের ক্ষমতাকে সীমিত করবার চেষ্টা করিনা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে কয়টি দল রয়েছে-তাদের কেউ কোনদিন বলেনি যে আমি ক্ষমতায় গেলে সরকারের দৌরাত্ম্য কমিয়ে আনবো-ট্যাক্স কমিয়ে আনবো-স্বৈরশাসন দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করবোনা। বাংলাদেশের সবকয়টি রাজনৈতিক দল রাজনীতিবিদ্যার ডান বাম বর্নালির ডানদিকেই পড়ে-সবাই বড় রাষ্ট্র চায়। হ্যা-ক্ষমতায় না থাকলে সবাই সরকারের বদনাম করে ঠিকই, কিন্তু কেউ বলেনা যে রাষ্ট্রের গঠনগত কোন একটা সমস্যা আছে, নাহলে বঙ্গবন্ধুর মতন অসাধারণ মানুষেরা ক্ষমতায় গিয়েও স্বৈরাচারিতার লাগাম ধরে রাখতে পারছে না কেনো? কারণটা খুব সহজ-কারণটা হলো আমরা স্বৈরাচারদের হাত থেকে কোনদিনই স্বাধীন হইলি। হ্যা, আমরা বৃটিশদের তাড়িয়েছি, পাকিস্তানিদের তাড়িয়েছি-কিন্তু তারা আমাদের যে চাবুক দিয়ে চাবকাতো সেটাকে ধ্বংস করবার চেষ্টা করিনি। আমাদের আমলাতন্ত্রে, প্রশাসনে, বিচার বিভাগে, শাসনতন্ত্রের প্রতিটা অংশে অংশে এখনো ঔপনিবেশিক নস্টালজিয়া। আমাদের রাষ্ট্রনায়কেরা এখনও রাজা রাণী হতে চান-বংশপরম্পরায় ক্ষমতা ধরে রাখতে চান, অঙ্গুলি হেলনে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে চান-কারণ তাদের হাতে তার সবকিছু করার অস্ত্রটি এখনও বিদ্যমান। কিছুই বদলায়নি-খালি শয়তান বদলেছে। একজনের হাত থেকে অন্যের হাতে আমরা উঠিয়ে দিয়েছি শোষণের চাবুক। তাই আমাদের বানানো দেবতারাই হয়ে উঠেছে আমাদের বানানো শয়তান।
গত দশ বছরে বাংলাদেশ সরকার যে পরিমান বিদেশী ঋণ আর অনুদান অপচয় করে যতটুকু উন্নয়ন করেছে তার চেয়ে অনেক বেশি অর্জন করেছে আমাদের সামাজিক উদ্যোগগুলো। ব্র্যাক পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে সফল এনজিওগুলির একটি। যতই সবাই গালিগালাজ করুক না কেনো-গ্রামীণ ব্যাংক সত্যিই ভালো কিছু কাজ করেছে আর আমার বয়েসী ছেলেপুলে প্রত্যেক শীতে কম্বল নিয়ে দিনাজপুরে দৌড় দিচ্ছে। আর সরকার লুটপাট করে, অপরাধীদের আস্তানা দিয়ে, শিক্ষাঙ্গনে অস্ত্র ঢুকিয়ে, ভয় আর বিভেদের রাজনীতি করে যত পারছে আমাদের কাজগুলোকে নষ্ট করবার চেষ্টা করছে। আমি নিশ্চিত সরকার আসলে ঠিক কতোটা খারাপ সেটা আমার চেয়ে এই লেখার পাঠক অনেক ভালো করে বলতে পারবে। কিন্তু আসলে কিন্তু দোষটা সরকারের না। দোষটা আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের-যেটি এমন করেই সাজানো হয়েছে যাতে করে একটি সরকার ঔপনিবেশিক শোষক সাম্রাজ্যবাদী হয়ে উঠতে বাধ্য করে।
আমাদের সত্যিকারের একটা বিপ্লবের খুব প্রয়োজন। একটা সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক বিপ্লব যেগুলো আমাদের সমস্যাগুলোকে নতুনভাবে ভাবতে শিখাবে। সত্যি সত্যি আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়-তবে সেই অধিকার সরকারের থেকে ভিক্ষা করে নেয়া অধিকার না। সেই অধিকার তার জন্মগত অধিকার- নিজের মুক্তিকে নিজে সংজ্ঞায়িত করবার অধিকার। সেই অধিকার পৃথিবীর কোন সরকার-কোন রাজনৈতিক দল বা কোন রাষ্ট্র কেড়ে নেবার অধিকার রাখে না। চার দশকের দূর্বল প্রশাসন আমাদের যথেষ্ট স্বায়ত্তশাসিত হতে শিখিয়েছে-শুধু অতিসবল রাষ্ট্রটিকে গুড়িয়ে দেবার অপেক্ষা, তাহলেই আমরা স্বাধীন হতে পারবো, আর স্বাধীনতা খুঁজতে হবে না কারু কাছে থেকে।
মুক্তিবাদের রাজনীতিতে স্বাগতম।